ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেছেন অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে সরাসরি আরাকান আর্মি বা রাখাইনে সিভিল প্রশাসনের সাথে কথা বলা উচিত। তিনি এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থেই অন্তর্বর্তী সরকারকে চীনের সমর্থন নিয়ে এবং জাতিসঙ্ঘের সহায়তায় রাখাইনে একদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সেফ জোন অন্যদিকে সেখানকার দুর্ভিক্ষময় পরিস্থিতি থেকে মানুষকে বাঁচাতে জরুরি ত্রাণসহায়তার উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানান। তবে এক্ষেত্রে ভারতকে এ উদ্যোগের সাথে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে সাবধান করে অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান বলেন, ভারত বরং স্যাবোটাজ তৈরি করবে। নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এম শাহীদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ আরাকান সঙ্কটের সাথে জড়াতে চায় না কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট নিরসনে যে কার্যকর আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রকট অভাব রয়েছে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আরাকান বা রাখাইনে সিভিল প্রশাসন ও আরাকান আর্মির সাথে আলোচনার উদ্যোগ নিলে একটা পথ বের হতে পারে। রাখাইন জনগোষ্ঠী বা আরাকান আর্মির অস্তিত্বের বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে পারলে তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নিতে নমনীয় হতে বাধ্য হবে। কারণ বাংলাদেশের সহায়তা ছাড়া রাখাইনের সিভিল প্রশাসন বা আরাকান আর্মির টিকে থাকা অসম্ভব।
অধ্যাপক শাহীদুজ্জামান বলেন, আরাকানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সেফ জোন তৈরি এখন সময়ের দাবি। কারণ বিশ্বে ড. অধ্যাপক মুহম্মাদ ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা অনেক উঁচুতে। আমেরিকা তাকে পাত্তা দেয়, আরাকান আর্মিও তাকে গুরুত্ব দেয়। ওনার যে বিশেষ উপদেষ্টা, রোহিঙ্গা সমস্যা এবং অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলির জন্য প্রধান উপদেষ্টার হাইরিপ্রেজেনটেটিভ ড. খলিলুর রহমান, তারও প্রচুর অভিজ্ঞতা রয়েছে। তো সেফ জোন সৃষ্টি করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আরাকানে ফেরত পাঠানো শুরু করতে হবে। আরাকান আর্মি দায়িত্ব নেবে। এক্ষেত্রে চীন বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। জাতিসঙ্ঘ সমর্থন দিতে পারে। প্রয়োজনে আরাকানে রোহিঙ্গাদের সেফ জোনে পাঠানোর পর তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতিসঙ্ঘের শান্তি মিশন পাঠাতে পারে। আমার মনে হয় না যে তাতমাডাও এতে বাধা দেবে। আরাকান আর্মির সমস্যায় রয়েছে।
নয়া দিগন্ত : কিন্তু আরাকান আর্মিতো ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি নিষিদ্ধ করেছে। তাদের কাছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কতটুকু সহযোগিতা আশা করা যায়। পণ্য সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল হলেও আরাকান আর্মি বাংলাদেশের জেলেদের অপহরণ করছে, বিভিন্ন সময় চাঁদা দাবি করছে, বাংলাদেশী জেলেদের লক্ষ্য করে গুলি করার মতো ঘটনাও ঘটছে।
এম শাহীদুজ্জামান : আরাকান আর্মিকে চাপ দিতে হবে। এবং সে চাপ দেয়ার প্রচুর সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে। কারণ আরাকান আর্মি কোনোভাবেই সেখানে বাংলাদেশের সমর্থন ছাড়া চলতে পারবে না। আরাকান আর্মি এতদিন মনে করেছে তারা নিয়ন্ত্রণহীন। চীন এক্ষেত্রে চাপ সৃষ্টি করলে আরাকান আর্মির নেতৃত্ব কিছুটা হলেও চিন্তা করে দেখবে। বাংলাদেশকে ছাড়া আরাকান আর্মির টিকে থাকা অসম্ভব। যদি আরাকানে খাদ্য, ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্য বাংলাদেশ থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সেখানকার যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, মিয়ানমারের জান্তা সেনারা পণ্য প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করছে, এভাবে চলতে থাকলে তো আরাকান বড় ধরনের দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করতে হলে আরাকান আর্মির বাংলাদেশের সহায়তা লাগবে। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস কিন্তু বলেছেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়েই আরাকানে ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে হবে। না হলে আরাকানবাসী না খেয়ে মারা যাবে।
নয়া দিগন্ত : এ ধরনের উদ্যোগ কিভাবে সম্ভব হয়ে উঠতে পারে?
এম শাহীদুজ্জামান : প্রথমত আরাকান আর্মিকে রাজি হতে হবে। আরাকান আর্মি কেন রাজি হবে। দু-একটা কারণ হচ্ছে সেখানকার সিভিলিয়ান পপুলেশন খাদ্যসঙ্কটে রয়েছে। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এখন যদি বাংলাদেশের মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রী বা ত্রাণসহায়তা যায় তো আরাকান আর্মি তা মেনে নিতে বাধ্য হবে। এটা আশা করা যায়। যদিও বাংলাদেশের এ ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে জড়াতে চায় না।
নয়া দিগন্ত : কিন্তু শুধু যে আরাকানে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে তা নয়, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাদ্যসহায়তা কমানো হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য সংস্থা একই সাথে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারে ১০ লক্ষাধিক মানুষের খাদ্যসহায়তা কমিয়ে দিচ্ছে। তো মিয়ানমার, আরাকান ও বাংলাদেশে এত বিপুল পরিমাণ শরণার্থী খাদ্যসঙ্কটে পড়লে, সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি চরমে যেতে পারে সেখানে আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কি জরুরি নয়?
এম শাহীদুজ্জামান : চীনের এখানে বড় ধরনের হস্তক্ষেপ করতে হবে। আরাকান আর্মি তা মেনে নিতে পারে। বাংলাদেশের সাথে চীন এখন সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক দূর এগিয়ে যেতে চায়। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা জিইয়ে রেখে বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলে এই সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে একটা বাধা হয়ে আছে। এটাকে অপসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ এ উদ্যোগ নিলে তাতে চীনের সমর্থন ও হস্তক্ষেপ দুইই প্রয়োজন পড়বে। সবকিছুই সম্ভাবনা। কিন্তু প্রক্রিয়া শুরু করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মাধ্যমে যদি জাতিসঙ্ঘ আরাকান বা রাখাইনে সাধারণ মানুষকে খাদ্যসাহায্য দেয়, তাহলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে রাখাইনে মানুষের মনোভাব পাল্টে যেতে পারে। আর এ মনোভাব না পাল্টালে আরাকান আর্মির কিছু করার নেই।
নয়া দিগন্ত : দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে প্রতিবেশী দেশগুলোর কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কেবল আশ্বাস মিলেছে। ভারত মিয়ানমারে কালাদান প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত। গত আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে আরো নতুন করে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ঢুকে পড়েছে। এ সঙ্কট নিরসনে চীনের সমর্থন, মিয়ানমারের এগিয়ে আসা, ভারতের প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব কিভাবে আশা করা যায়?
এম শাহীদুজ্জামান : এখানে অন্যদের স্বার্থের সাথে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসন কিভাবে মেটানো যায় সে লক্ষ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। দীর্ঘমেয়াদে আরাকান আর্মির বাংলাদেশের সহায়তা দরকার। চীনও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষ নজর দিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে রাখাইনে সিভিল প্রশাসনের সম্মতি লাগবে। এ ধরনের সম্মতি পাওয়া যেতে পারে যদি তাদেরকে দুর্ভিক্ষময় পরিস্থিতি থেকে বাঁচানো যায়। এবং সেটা বাংলাদেশের জন্য একটা সুযোগ। কিন্তু সরকার যদি উদ্যোগ না নেয় বা জড়াতে না চায় তাহলে এ সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। প্রয়োজনে আর্মস কনভয়ের মাধ্যমে নদী পার হয়ে রাখাইনে খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ বাংলাদেশ নিলে আরাকান আর্মি হয়তো রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে নমনীয় বা রাজি হতে পারে।
নয়া দিগন্ত : চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য কিন্তু রাখাইনে পৌঁছে যাচ্ছে। এটা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরে দেখা যাচ্ছে।
এম শাহীদুজ্জামান : বাংলাদেশ এক্ষেত্রে উদ্যোগ নিতে পারে এটা হাইপোথেসিস। কাল্পনিক হলেও তা সম্ভাবনা। যেটার বিপক্ষে অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু এটা একটা জটিল সম্ভাবনা। এটা জাস্ট উত্থাপন করা যায়। কারণ এটা ছাড়া সামনে কোনো কিছু দেখা যায় না। রাখাইনে সেফ জোন সৃষ্টি করতে পারলে সেখানে যাওয়ার জন্য একটা অল্টারনেটিভ দরকার হবে। এবং আরাকান আর্মি ও রাখাইন জনগোষ্ঠীতে এমন কোনো অস্তিত্বের বাধ্যবাধকতা দেখাতে হবে যে জন্য তারা বাধ্য হবে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে চিন্তা করতে। এটা নির্ভর করবে জাতিসঙ্ঘকে অনুধাবন বা আগ্রহে নিতে হবে, বাংলাদেশকেও রাজি হয়ে রাস্তাটা বেছে নিতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা চীন এখানে আদৌ এগিয়ে আসতে পারবে কি না। এখানে ভারতের কোনো রোল বা ভূমিকা আমি আশা করি না কারণ ভারত বরং উল্টো স্যাবোটাজ তৈরি করতে চেষ্টা করবে। আমেরিকারও রোল থাকবে কারণ তারা চাইবে একটা দুর্ভিক্ষময় শঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সহায়তা দিয়ে রাখাইন জনগোষ্ঠীকে বাঁচানো যায় কি না। তাদের একটা মানবিক ভূমিকা থাকবেই। মার্কিনিরা এটাকে সাপোর্ট করবে। আমার ধারণা। আর বাংলাদেশের জন্য এখন যেহেতু ইউনূস সরকার রোহিঙ্গাদের একটা আশ্বাস দিয়েছে হয়তো আগামী ঈদ তারা আরাকানে করতে পারবে তার মানে তার বেশ কনফিডেন্স আছে, হয়তো সরকার চেষ্টা করবে।
নয়া দিগন্ত : রাখাইনে সেফ জোন তৈরির ব্যাপারে আরাকান আর্মির সাথে এ ধরণের উদ্যোগ তো জাতিসঙ্ঘ নিতে পারে।
শাহীদুজ্জামান : যদি জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল আরাকান আর্মির সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারে, রোহিঙ্গাদের একটা সেফ জোনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে অপরিহার্য। আবার রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষে যদি চীনের কোনো ইচ্ছা থেকে থাকে, তবে এটিই হবে সুযোগ। যত দিন প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশের দায়িত্বে রয়েছেন তত দিন আমার মনে হয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা না একটা উপায় বের হবেই। বাংলাদেশের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বিশেষ করে প্রফেসর ইউনূসকে তিনি খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক তার সফর ছাড়াও রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কিছুটা শর্টফল থাকলেও কিন্তু সহায়তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। এখন অন্য কোনো সোর্স থেকে রোহিঙ্গাদের সহায়তার ঘাটতি মেটাতে জাতিসঙ্ঘ চেষ্টা করবে। তো এমন একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে কর্মকৌশল প্রণয়নে সুস্পষ্ট ও প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব রোহিঙ্গাদের পাশে থেকে এটুকু উপলব্ধি করেছেন যে তাদের অন্য কোনো দেশে থাকার সামান্যটুকু আগ্রহ নেই; বরং তারা নিজেদের দেশেই ফেরত যেতে চায়। মিয়ানমারের প্রতি তাদের আনুগত্য ও তারা যে ওই দেশের নাগরিক তারা তা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের অত্যন্ত গভীর আকাক্সক্ষা একটা লারনিং এক্সপ্রেরিয়েন্স ছিল। এখন মহাসচিব আরাকান আর্মিকে যদি কনভে করেন যে রোহিঙ্গাদের একটা সেফ জোনে নিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে আরাকান আর্মির যতটুকু বৈধতা জাতিসঙ্ঘের কাছে আছে ভবিষ্যতে ততটুকু গ্রহণযোগ্যতা আর থাকবে না। এরকম একটা শর্ত বা এরকম একটা বার্তা যদি মহাসচিব আরাকান আর্মিকে পৌঁছে দেন তাহলে এটা বড় ধরনের কূটনৈতিক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে রাখাইন জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নেতিবাচক তাদের এ মনোভাবকে ইতিবাচক হিসেবে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।
নয়া দিগন্ত : জাতিসঙ্ঘের কাছে আরাকান আর্মির কোন ধরনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে?
শাহীদুজ্জামান : ভবিষ্যতে যদি আরাকান আর্মি স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চায় বা অন্তত পক্ষে স্বায়ত্তশাসন চায় বা একটা সরকার গঠন করতে চায় সেখানে জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃতি ও বৈধতা তাদের দরকার হবে। জাতিসঙ্ঘ চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তার প্রচণ্ড শক্তি রয়েছে, তার যে বিশেষায়িত সংস্থাগুলো রয়েছে বিশ্বব্যাপী, সেগুলোর সদস্য পদ পাওয়াটা রাখাইন জনগোষ্ঠী বা আরাকান আর্মির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি আন্তর্জাতিক হিসেবে বৈধতা বা রাষ্ট্র হিসেবে সম্মতি পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক পদক্ষেপ হবে। ফিলিস্তিন বা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময় জাতিসঙ্ঘের এ ধরনের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে এককভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত আরাকান আর্মি জাতিসঙ্ঘের কাছ থেকে কোনো সহায়তা বা আশ্বাস পায়নি, সে দিক থেকে চিন্তা করলে বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের সফর এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর যে আকুতি এবং প্রফেসর ইউনূসের বিশ্বব্যাপী যে সংযোগ রয়েছে বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরাষ্ট্র যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন যতখানি সমর্থন দিতে পারে, সেটি মনে হয় আগামী এক বছরে, আমি যদি ভুল শুনে না থাকি, তিনি কিন্তু আশ্বাসও দিয়েছেন যে আগামী বছর এ সময় রোহিঙ্গারা নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারবেন।
নয়া দিগন্ত : এক বছরে রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণভাবে ফিরিয়ে নেয়া বা ধাপে ধাপে ফিরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব কিন্তু বাংলাদেশ অনেক আগে থেকেই মিয়ানমারের কাছে করে এসেছে।
শাহীদুজ্জামান : আরাকান আর্মির সাথে অন্তর্বর্তী সরকারে একটা আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। আমার ধারণা সেখানে বাংলাদেশের সাথে আরাকান আর্মির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এটি সত্যি আরাকান আর্মির পক্ষে দুটো শত্রু মেইনটেইন করা প্রায় অসম্ভব। এক দিকে তাতমাডাও যাদের বিরুদ্ধে তারা এখনো লড়ছে, সিতুইয়ের আশপাশে আরাকান আর্মি এখনো নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি। তাতমাডাও বিমান আক্রমণ করতে মরিয়া হয়ে যাতে সিতুইয়ের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ধরে রাখা যায়। আবার মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রাশিয়ার কাছে সামরিক সাহায্য চেয়েছে এবং খুব সম্ভবত তারা তা পাবে, বিমান আক্রমণ আরো বৃদ্ধি করলে তা আরাকান আর্মির জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনবে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, সেখানে সেফ জোনে কিভাবে নিরাপত্তা দেবে আরাকান আর্মি তারা তা তুলে ধরবে। সেখানেই জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের ভূমিকাটা কার্যকর হয়ে যায়। তিনি বলতে পারেন আগামীতে রাখাইনে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী ব্যবহার করতে রাজি আছে। মিয়ানমারের ব্যাপারে বার্মা অ্যাক্ট এখনো কার্যকর বিধায় রাখাইনে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর উপস্থিতির ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে বলে মনে হয়। বিশ্বে ইসরাইল, মিসর ও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সহায়তার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এখনো অব্যাহত রেখেছে যদিও সেখানে কিছুটা শর্টফল হয়েছে। আরাকান অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব রাখতে রিপাবলিকান প্রশাসন যে আগ্রহী এ থেকে তা পরিষ্কার। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রফিট মোটিভকে অগ্রাধিকার দেন বলে আরাকান অঞ্চলে যে রিসোর্স রয়েছে সেখানে একচেটিয়া চীনের অগ্রাধিকার থাকবে এটি ট্রাম্প প্রশাসন মেনে নেবে না। ভারতও যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দেবে। এখানে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলে মিয়ানমারে ভারতের কালাদান প্রজেক্ট সম্পূর্ণভাবে লস হয়ে যাবে। কোনো দিন লাভজনক হবে না। এ দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে আরাকান আর্মিকে চাপ দেয়া হোক। তাতমাডাওয়ের সাথে জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে বাংলাদেশও আলোচনা করতে পারে কিভাবে সে তার সামরিক শক্তি পূর্বের মতো ফেরত পেতে চায়, কারণ তারা তাদের নৌবাহিনীকে এখনো ব্যবহার করছে। সেখানে বাংলাদেশ কী রোল প্লে করতে পারে কারণ তাতমাডাও একবার রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেছে। আরাকান আর্মির সাথে কিছুতেই তাতমাডাও আর পেরে উঠছে না, সেখানে বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাব থাকলে যেটি তাতমাডাওকে সাহায্য করতে পারে, আমার ধারণা তাতমাডাও সেটা লুফে নেবে।
নয়া দিগন্ত : অন্তর্বর্তী সরকারের চীন সফরে বাংলাদেশ কিভাবে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে সাহায্য চাইতে পারে?
শাহীদুজ্জামান : জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের পর অধ্যাপক ইউনূস যথেষ্ট কর্তৃত্ব নিয়ে তার উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে এ সঙ্কট নিরসনে উদ্যোগী হয়ে উঠতে বলবেন। চীন এখন বাংলাদেশের ইকোনমিক ডিফিকাল্টিসগুলো অ্যাড্রেস করতে রাজি। অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বছরের পর বছর চীন আশ্বাস দিয়েছে; কিছু করেনি। যদি আদৌ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রতি চীনের কিছু করার থাকে, সহানুভূতি থেকে থাকে, তাহলে এটিই হবে সুযোগ। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় যে শর্টফল তা মেটাতে হয়তো চীন নিজে থেকেই এগিয়ে আসবে।