আধুনিক কৃষির যুগেও টিকে আছে নীরব প্রহরী

মনিরুজ্জামান সুমন, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা)
Printed Edition
দামুড়হুদার একটি বেগুন ক্ষেতে কাকতারুয়া: নয়া দিগন্ত
দামুড়হুদার একটি বেগুন ক্ষেতে কাকতারুয়া: নয়া দিগন্ত

কৃষকের জমিতে শত্রুর অভাব নেই, কেউ ডানায় ভর করে উড়ে আসে, কেউ আবার রাতে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ায়। এসব শত্রুর বিরুদ্ধে হাজার বছরের পুরনো অস্ত্র, কাকতাড়ুয়া, আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মাঠে। মানুষ নয়, তবু মানুষের পোশাক পরে নিঃশব্দে পাহারা দেয় সে। কথা বলে না, হাঁটেও না, অথচ ভয় দেখিয়েই পাখির দলকে দূরে রাখতে পারে।

দামুড়হুদা উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়, বাঁশের কাঁধে খড়ের দেহ, মাথায় মাটির হাঁড়ি, হাঁড়ির গায়ে কয়লা বা সাদা রঙে আঁকা চোখ-মুখ। দূর থেকে তাকালে মনে হয়, যেন কেউ হাত দুটো প্রসারিত করে ফসলের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। ভালো করে না দেখলে পথচারীরাও কখনো কখনো চমকে ওঠে। এখন কৃষকের হাতে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ছড়াছড়ি, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, উন্নত জাতের বীজ সবই আছে। তবু অনেকেই ছাড়েননি কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার। কারণ এতে পাখিকেও ভয় দেখানো যায়, আবার কোনো প্রাণহানিও হয় না, পরিবেশ নিরাপদ থাকে, খরচও শূন্য।

নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত মাঠে মাঠে কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার ছিল ব্যাপক। সময় বদলেছে, প্রযুক্তি এগিয়েছে, তবু কিছু কৃষকের বিশ্বাস এখনো অটুট। তাদের ধারণা, কাকতাড়ুয়া থাকলে পাখির দল ক্ষেতে কম নামে, ফসলও রক্ষা পায়। রুদ্রনগরের কৃষক গাফ্ফার হোসেন বলেন, ‘বীজ বুনলেই পাখিরা জমিতে উৎসব শুরু করে। সারাদিন পাহারা দেয়া সম্ভব না বলে ক্ষেতেই দাঁড় করাই কাকতাড়ুয়া। রাতে সে পাহারা দেয়, দিনে আমরা।’ চণ্ডিপুরের হাসমত আলি মাস্টার জানান, ‘বাঁশ, খড় আর পুরনো জামা দিয়েই বানাই। এমন বানাই, দেখলেই মনে হয় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পশুপাখি ভয় পায়, আর আমরা হাসি।’

পরানপুরের কৃষক সাইফুল ইসলাম মুকুল বলেন, ‘কাকতাড়ুয়া দিলে পাখি কম আসে। না দিলে সকাল-বিকেল হাট বসে যায় ক্ষেতে।’ বাতাসে কাকতাড়ুয়া একটু নড়লেই পাখির মনে হয় যেন কেউ হাঁটছে। এই ভ্রান্ত বিশ্বাসেই কাক, শালিক, ঘুঘু, চড়ুই দূরে থাকে। তাই কাকতাড়ুয়া হয়ে উঠেছে সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব প্রহরী, নেই খরচ, নেই ক্ষতি, নেই অপরাধ। দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, ‘কাকতাড়ুয়া পাখি ছাড়াও ইঁদুর ও নিশাচর প্রাণীর আগ্রাসন কমায়। ফসল নিরাপদ থাকে। পাখি মারা আইনগত অপরাধ, কাকতাড়ুয়া সেই ঝুঁকিও দূর করে। এটি কৃষকের বন্ধু, পরিবেশেরও বন্ধু।’