স্বাধীনতার পর পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় বৈদেশিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে ১৯৭০-এর দশকে অনুদাননির্ভর সহায়তা যেখানে প্রধান ছিল, সেখানে এখন তা দ্রুত ঋণনির্ভর হয়ে উঠছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১/৭২ অর্থবছর থেকে ২০২৩/২৪ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দাঁড়িয়েছে ১৯১.২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে ঋণ ১৫৩.১৫ বিলিয়ন ডলার এবং অনুদান মাত্র ৩৮.১১ বিলিয়ন ডলার। এই বিশাল অঙ্ক বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে সম্পর্কের গঠনমূলক পরিবর্তনের পাশাপাশি ঋণ নির্ভরতার গভীরতাও নির্দেশ করছে।
ঋণ বনাম অনুদান : অনুদান এখন এক-পঞ্চমাংশ
১৯৭০-৮০ দশকে বাংলাদেশের বৈদেশিক সহায়তার বড় অংশ আসত অনুদান ও খাদ্য সহায়তা হিসেবে। কিন্তু ২০২০-এর দশকে এসে চিত্রটি উল্টে গেছে। ইআরডির পরিসংখ্যান অনুযায়ী- মোট প্রতিশ্রুত ১৯১.২৬ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৮০ শতাংশই ঋণ। অনুদান অংশ মাত্র ৩৮.১ বিলিয়ন ডলার, যা মোট সহায়তার এক-পঞ্চমাংশেরও কম। তুলনামূলকভাবে, ঋণ সহায়তা ১৯৭১-৮০ দশকের তুলনায় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পথে থাকায় উন্নয়ন সহযোগীরা অনুদানের পরিবর্তে সুদের হার অপেক্ষাকৃত কম এমন রেয়াতি ঋণকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। সরকারের সাবেক একজন কর্মকর্তার মতে- ‘এটি স্বাভাবিক রূপান্তর, তবে সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা ও প্রকল্প ব্যয়-ফল অনুপাত এখন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।’
বিদেশী সহায়তায় প্রবৃদ্ধি কমলেও ঋণ পরিশোধ বেড়েছে
বাংলাদেশের বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণের প্রবণতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছুটা মন্থর হলেও ঋণ পরিশোধের চাপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৯.২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সহায়তা গ্রহণ করেছে, যা আগের অর্থবছরের ১০.৯৭ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ১৫.৬ শতাংশ কম।
অন্য দিকে, একই সময়ে ঋণ পরিশোধ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৬৭ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি। এতে দেশের বৈদেশিক ঋণের বোঝা আরো দৃশ্যমানভাবে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২.৩১ বিলিয়ন ডলার, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৩.৭৩ শতাংশ।
প্রকল্প সহায়তা এখনো মূল চালিকাশক্তি
প্রাপ্ত সহায়তার প্রায় পুরোটাই এসেছে প্রকল্প সহায়তা থেকে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রকল্প সহায়তা ছিল ৯.২১ বিলিয়ন ডলার, যা মোট প্রাপ্ত সহায়তার ৯৯ শতাংশের বেশি। খাদ্য সহায়তা বা কমোডিটি এইডের অংশ এখন খুবই সীমিত, মাত্র ৫২.৫ মিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদেশী সহায়তার ধরন পরিবর্তন হচ্ছে- অনুদানভিত্তিক সহায়তা কমে যাচ্ছে, বাড়ছে ঋণনির্ভর প্রকল্প বিনিয়োগ। এতে উন্নয়ন প্রকল্পের গতি বজায় থাকলেও ঋণ পরিষেবা দায় বাড়ছে দ্রুত হারে।
ঋণ পরিশোধে বড় ধাক্কা : দ্বিগুণের কাছাকাছি
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ১.৭৩ বিলিয়ন ডলার মূলধন এবং ০.৯৩ বিলিয়ন ডলার সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে। সে তুলনায় আগের অর্থবছরে সুদ পরিশোধ ছিল ০.৪৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে সুদ পরিশোধের পরিমাণ।
ইআরডি সূত্র অনুযায়ী, এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার অন্যতম কারণ হলো নতুন কিস্তিতে উচ্চ সুদের বৈদেশিক ঋণ, বিশেষত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান (জাইকা) এবং সাম্প্রতিক সময়ে আইএমএফ ও এ আইআইবি-এর ঋণ চুক্তি।
ঋণ-রফতানি অনুপাতেও চাপ বাড়ছে
২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট বহিঃঋণ পরিশোধ দেশের রফতানি আয়ের ৫.১ শতাংশ। আগের বছর এটি ছিল ৪.১ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি রফতানি আয় প্রত্যাশিতভাবে না বাড়ে এবং ঋণ পরিশোধের ধারা একই থাকে, তা হলে আগামী দুই বছরে এই অনুপাত ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়।
কমিটমেন্ট বনাম বাস্তব সহায়তা
ইআরডি-এর ঐতিহাসিক ঋণ তথ্য (১৯৭১/৭২-২০২৩/২৪)অনুসারে, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক সহায়তা প্রতিশ্রুতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯১.২৭ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু বাস্তব প্রাপ্তি হয়েছে ১৩২.৮১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মোট প্রতিশ্রুত সহায়তার প্রায় ৩০ শতাংশ বাস্তবে আসেনি।
এর মধ্যে শুধু প্রকল্প ও বাজেট সহায়তা খাতেই প্রতিশ্রুতি ছিল ১৭৩.১৪ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ১১৪.৮৩ বিলিয়ন ডলার। অন্য দিকে, খাদ্য ও কমোডিটি সহায়তা অনেক আগেই কার্যত স্থবির অবস্থায় পৌঁছেছে।
প্রকল্প সহায়তা : সর্বাধিক অবদান, সর্বাধিক চাপ
তিনটি প্রধান খাতের মধ্যে- খাদ্য সহায়তা, পণ্য সহায়তা এবং প্রকল্প সহায়তা ও বাজেট সহায়তা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সহায়তা এসেছে প্রকল্প সহায়তা ও বাজেট সহায়তা খাতে। এই খাতেই প্রতিশ্রুতি দাঁড়িয়েছে ১৭৩.১৪ বিলিয়ন ডলার এবং বিতরণ হয়েছে ১১৪.৮৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, মোট প্রতিশ্রুত অর্থের প্রায় ৬৬ শতাংশ এখনো বাস্তবায়িত হয়েছে।
এটি বোঝায়, অনেক বড় প্রকল্প এখনো পাইপলাইনে রয়েছে, যার পরিমাণ ৪২.৮ বিলিয়ন ডলার। এই পাইপলাইন মূলত চলমান বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পগুলো- যেমন পদ্মা রেল সংযোগ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন অবকাঠামোর সাথে সম্পর্কিত।
খাদ্য ও পণ্য সহায়তার দিন শেষ
স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশকে খাদ্য সহায়তা ছিল বৈদেশিক সহযোগিতার অন্যতম উৎস। কিন্তু এখন তা কার্যত প্রান্তিক অবস্থায়। বর্তমানে খাদ্য সহায়তার প্রতিশ্রুতি মোটের মাত্র ৩.৭ শতাংশ এবং বিতরণ প্রায় ৭.০৬ বিলিয়ন ডলার। একইভাবে পণ্য সহায়তা- যা মূলত পণ্য আমদানি সহায়তা ও বাজেট সহায়তার অংশ ছিল, এখন কমে দাঁড়িয়েছে ১০.৯ বিলিয়ন ডলার বিতরণে।
অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, এটি বাংলাদেশের আত্মনির্ভরশীল খাদ্য উৎপাদন ও রফতানি সক্ষমতা বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রতিফলন।
প্রতিশ্রুতি বনাম বিতরণ : ব্যবধান বাড়ছে
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রাপ্ত বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি ও বিতরণের মধ্যে ব্যবধান প্রায় ৫৮.৪ বিলিয়ন ডলার। এটি এক অর্থে বোঝায়- অনেকে অর্থপ্রদান করলেও, বাস্তব প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে পুরো অর্থ ছাড় হচ্ছে না।
‘প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্বল প্রস্তুতি এই ব্যবধানের মূল কারণ।’ মন্তব্য করেন ইআরডির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
ঋণ ঝুঁকি ও টেকসই ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের গড় সুদের হার এখনো তুলনামূলকভাবে কম (প্রায় ১১.৫%), তবে ঋণের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে। ইআরডির সাম্প্রতিক অনুমান অনুযায়ী, দেশের মোট বহিঃঋণ এখন ১১২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশ সরকারি বা সরকার-গ্যারান্টিযুক্ত।
বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান ও চীন এখন প্রধান ঋণদাতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋণ টেকসই রাখতে নতুন প্রকল্প অনুমোদনের আগে ফলপ্রসূতা (আরওআই) বিশ্লেষণ বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
বিশ্বব্যাংক-জাইকা-চীন : তিন শীর্ষ ঋণদাতা
বর্তমানে বাংলাদেশে বৈদেশিক সহায়তার প্রধান উৎস তিনটি- বিশ্বব্যাংক, জাইকা (জাইকা, জাপান), চীন সরকার ও এক্সিম ব্যাংক অব চায়না। বিশ্বব্যাংক এককভাবে বাংলাদেশের মোট বহিঃঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ, জাইকা ২২ শতাংশ এবং চীন ১৭ শতাংশ বহন করছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইএফএড ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, বিশেষ করে কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে।
আত্মনির্ভরতার পথে বাংলাদেশ
৫০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ বলছে- খাদ্য ও পণ্য সহায়তার যুগ শেষ, এখন প্রকল্প ও বাজেট সহায়তার যুগ; অনুদান থেকে ঋণে রূপান্তর প্রায় সম্পূর্ণ; সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ের (এডিপি) প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ এখনও বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। তবে দেশীয় রাজস্ব আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ফলে আত্মনির্ভরতার গতি ত্বরান্বিত হচ্ছে।
অর্ধশতকে পা দেয়া বাংলাদেশের বৈদেশিক সহায়তা কাঠামো এখন এক নতুন বাস্তবতায় দাঁড়িয়েছে- যেখানে ঋণই প্রধান চালিকাশক্তি, আর অনুদান ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। এটি উন্নয়ন অগ্রগতির স্বীকৃতি হলেও ভবিষ্যতের জন্য একটি সতর্ক বার্তা : টেকসই ঋণ ব্যবস্থাপনা, দক্ষ প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বৈদেশিক নির্ভরতা কমানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
‘বৈদেশিক সহায়তা এখন আর দান নয়, এটি বিনিয়োগ। তাই বিনিয়োগের রিটার্ন নিশ্চিত করাই আগামী দশকের মূল নীতি হওয়া উচিত’ বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
বিশ্লেষণ : প্রবৃদ্ধির ভার ঋণের কাঁধে
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বিদেশী সহায়তার কাঠামো এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি দ্বিমুখী প্রভাব ফেলছে। এক দিকে উন্নয়ন প্রকল্পের তহবিল জোগান ও অবকাঠামো বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করছে; অন্য দিকে ঋণ পরিশোধের চাপ এবং সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এমন সময়ে, যখন রফতানি আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের পথে বাংলাদেশের জন্য ‘ঋণ স্থায়িত্ব’ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও ব্যয়ের দক্ষতা না বাড়লে ২০২৭-২৮ সালের মধ্যে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় বিদেশী সহায়তা এখনো অপরিহার্য হলেও তার কাঠামোগত রূপান্তর ঘটেছে। অনুদাননির্ভরতা থেকে ঋণনির্ভরতায় আসার ফলে প্রকল্প অর্থায়ন বাড়ছে, কিন্তু অর্থনৈতিক ঝুঁকিও বাড়ছে বহু গুণে। আগামী অর্থবছরে এই ভারসাম্য রক্ষা করা নীতিনির্ধারকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
 


