ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। তাগাদা দিয়েও দেশের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজগুলোকে নির্ধারিত মেয়াদে শেষ করানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে দেশের মানুষ উন্নয়ন প্রকল্প থেকে যথাসময়ে সুফল পাচ্ছে না। গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টে গ্যাস স্টেশন স্থাপন ও মডিফিকেশন প্রকল্পটিও একই রোগে আক্রান্ত। তিন বছরের প্রকল্পটি পৌনে চার বছরে অগ্রগতি মাত্র ৫০.৭৭ শতাংশ। বাকি ৪৯ শতাংশ কাজ শেষ করতে হবে বর্ধিত ১৫ মাসের মধ্যে। নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়াতে প্রকল্পের খরচ ২৭১ কোটি টাকার বেশি বেড়েছে। এই পৌনে চার বছরে প্রধান প্রধান কাজের অগ্রগতি মাত্র ১৪ থেকে ৩০ শতাংশের মধ্যে। মন্ত্রণালয় বলছে, জিনিসপত্র আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খোলার জটিলতার কারণে প্রকল্পের কাজ দেরিতে শুরু হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির পর্যবেক্ষক সংস্থা এমআরআই অ্যাসোসিয়েট বলছে, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা, আর্থিক বরাদ্দের সমস্যা ও ডলার সঙ্কট প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। প্রকল্পটির উপকারভোগী কোম্পানিগুলো (টিজিটিডিসিএল, কেজিডিসিএল, বিজিডিসিএল, জেজিডিএসএল ও পিজিসিএল) হতে ঋণ গ্রহণ এবং জিটিসিএলের ম্যাচিং ফান্ডের মাধ্যমে সম্পাদন করা হচ্ছে। বর্তমানে কোম্পানিগুলোর তারল্য সঙ্কটের কারণে সময়মতো অর্থ সংস্থান বিঘিœত হচ্ছে। প্রকল্পের সেফটি হেলথ এবং পরিবেশগত বিষয়গুলো পালন হচ্ছে না সরেজমিন পর্যবেক্ষণ থেকে এমনটিই পাওয়া গেছে।
জ্বালানি ও খণিজসম্পদ বিভাগের প্রকল্প দলিলের তথ্য বলছে, প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের প্রধান খনিজসম্পদ। বর্তমানে দেশীয় উৎপাদিত দুই হাজার ৫৫০ এমএমএসসিএফডি গ্যাস এবং আমদানিকৃত এলএনজি হতে প্রাপ্ত ৮শ’ এমএমএসসিএফডি গ্যাসের শত ভাগ জিটিসিএল গ্যাস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিতরণ কোম্পানিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। উৎপাদিত ও আমদানিকৃত এলএনজি হতে প্রাপ্ত গ্যাস পেট্রোবাংলার ছয়টি (ছয়) বিতরণ কোম্পানিতে তাদের গ্যাসের সঠিক পরিমাণ নির্ধারণপূর্বক সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য জাতীয় গ্যাস গ্রিডের বিভিন্ন বিতরণ পয়েন্টে থাকা আবশ্যক। বর্তমানে জাতীয় গ্যাস গ্রিডের অধিকাংশ বিতরণ পয়েন্টে মিটারিং ব্যবস্থা রয়েছে। যেসব স্থানে মিটারিং ব্যবস্থা নেই, সে সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানির মাসিক গ্যাস ভোগের পরিমাণকে অফ-ট্রান্সমিটার গ্যাস সরবরাহ বিবেচনা করা হয়। বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির প্রকৃত গ্যাস ভোগের পরিমাণ নির্ধারণের লক্ষ্যে এই প্রকল্প নেয়া। এতে কিছু স্থানে নতুন মিটারিং ব্যবস্থা স্থাপন এবং বিদ্যমান মিটারিং ব্যবস্থার মডিফিকেশন করতে হবে। এসব হলে বিতরণ কোম্পানিগুলোর গ্যাস ভোগের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা যাবে।
পেট্রোবাংলার আওতাধীন গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ কর্তৃক গত ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর ‘জিটিসিএলের অফ-ট্রান্সমিশন পয়েন্টে গ্যাস স্টেশন স্থাপন ও মডিফিকেশন’ অনুমোদিত হয়। তখন ব্যয় ছিল ৬৬৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। তিন বছর মেয়াদে ২০২৪ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। পরে প্রথম সংশোধনী অনুযায়ী প্রকল্পটির মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৯৩৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকায় এবং বাস্তবায়নকাল জুলাই, ২০২১ থেকে জুন, ২০২৬ পর্যন্ত দুই বছর বাড়ানো হয়। এতে খরচ বাড়ে ২৭১ কোটি ১১ লাখ টাকা।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল
প্রাকৃতিক গ্যাসের সুষ্ঠু ব্যবহার, গ্যাস পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে জিটিসিএলের গ্রিড হতে বিভিন্ন ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে পরিমাপকৃত ও মানসম্পন্ন গ্যাস সরবরাহ করা।
প্রকল্পের প্রধান প্রধান কার্যক্রম হলো:
ভূমি অধিগ্রহণ, সাড়ে তিন শ’ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন একটি, ২৫০ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি, ৫০ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন সাতটি অর্থাৎ মোট ১০টি (সিজিএস বা টিবিএস বা আরএমএস) ও তিন শ’, ২৫০ ও দেড় শ’ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন তিনটি মিটারিং স্টেশন স্থাপন। ছয়টি হট ট্যাপিং এবং চারটি স্টেশনে মডিফিকেশন কার্য সম্পাদন।
কাজের অগ্রগতি পৌনে ৪ বছরে
পতিত আওয়ামী লীগ আমলে নেয়া এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি তিন বছর ৯ মাসে অর্থাৎ ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি ৫০.৭৭ শতাংশ অর্জনে খরচ হয়েছে ৪৭৬ কোটি ৫৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৫০.৭৭ শতাংশ। আর প্রকল্পের সাতটি আইটেমের বাস্তব অগ্রগতি ৩০ শতাংশ ও পাঁচটি আইটেমের বাস্তব অগ্রগতি ১৫ শতাংশ। প্রকল্পের অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ সময়ে ওই ১২টি আইটেমের বাস্তব অগ্রগতি এক শ’ শতাংশ করতে হলে আইটেমভিত্তিক গ্র্যান্টচার্ট প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে বলে আইএমইডি অভিমত দিয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় সর্বমোট ৫.০৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। নির্মাণকাজের মধ্যে আশুলিয়াতে একটি ও ডেমরাতে একটি সিজিএস কাজ, গাড়ারানে একটি মিটারিং স্টেশন স্থাপন কাজ, আমিনবাজার স্টেশন ও মনোহরদী স্টেশন মডিফিকেশন কাজ এবং ছয়টি হট-ট্যাপিং কাজ ইতোমধ্যে এক শ’ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের বাকি প্রধান প্রধান কাজের অগ্রগতি ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ।
এ দিকে আমিনবাজার স্টেশনে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে কোনো পানি সরবরাহ ব্যবস্থা নেই। এখানকার ফিল্ডে অল্প কাপাসিটির কয়েকটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রয়েছে। কন্ট্রোল রুমের প্যানেল বোর্ডের আশপাশে কোনো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দেখতে পাওয়া যায়নি। গ্যাস স্টেশন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রাকৃতিক গ্যাস নিরাপত্তা বিধিমালা-১৯৯১ (সংশোধিত ২০০৩) মোতাবেক পর্যাপ্ত পরিমাণ অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা এই স্টেশনে অনুপস্থিত।
বাস্তবায়নে বিলম্বের কারণ:
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিনিসপত্র আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খোলার জটিলতার কারণে প্রকল্পের কাজ দেরিতে শুরু হয়। আর ডলার সঙ্কট, মার্কিন ডলারের বিনিময়মূল্য বৃদ্ধি, শীতলপুরে ২৫ কোটি ঘনফুট সম্পন্ন টিবিএস স্থাপন বাতিল এবং আরএমএস বা সিজিএস বা টিবিএস ও মিটারিং স্টেশন স্থাপনের জন্য কারিগরিভাবে গ্রহণযোগ্য দরপত্রের আর্থিক প্রস্তাব ডিপিপিতে উল্লিখিত প্রাক্কলিত মূল্যের থেকে বেশি হওয়াসহ অন্যান্য জটিলতা প্রকল্পের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। যার কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশোধনে প্রয়োজন হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদকাল মূল ডিপিপির তুলনায় দুই বছর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১.৪১ গুণ।
পর্যবেক্ষক সংস্থা এমআরআই অ্যাসোসিয়েট বলছে, আরএমএস বা সিজিএস স্টেশনগুলোর অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথভাবে কার্যকর করার জন্য স্থাপিত অগ্নিনির্বাপণ সিস্টেমে জকি পাম্প সংযোজন করা যেতে পারে। মিটারিং ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের সাথে একাধিক স্টেকহোল্ডার জড়িত থাকায় মিটারিং ব্যবস্থার পরিবীক্ষণ, ক্যালিব্রেশন, রিডিং গ্রহণ ইত্যাদি সংক্রান্ত কার্যক্রম পেট্রোবাংলার মাধ্যমে সমন্বয় করতে হবে। সিস্টেম লসের প্রকৃত পরিমাণ পরিমাপ করে কোম্পানিগুলো সার্ভিস এলাকাকে বিভিন্ন জোনে ভাগ করে মাসভিত্তিক সিস্টেম লস কমানোর পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কোম্পানিগুলো তা বাস্তবায়ন করে মাসভিত্তিক প্রতিবেদন পেট্রোবাংলার মাধ্যমে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে প্রেরণ করা যেতে পারে। অফ-ট্রান্সমিশন মিটারিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে জিটিসিএলের যে পরিমাণ কারিগরি/সিস্টেম লস হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হতে পারে তা বিবেচনায় নিয়ে ওই কারিগরি/সিস্টেম লস অনুমোদনের জন্য বিইআরসির কাছে জিটিসিএল আবেদন করতে পারে। প্রকল্পটি অতিদ্রুত এক্সটার্নাল অডিটের মাধ্যমে নিরীক্ষণ করতে হবে।