সহায়তা পেলে বছরে ২০০ কোটি ডলারের ওষুধের কাঁচামাল রফতানি সম্ভব

হামিম উল কবির
Printed Edition

সরকারি সহায়তা পেলে বাংলাদেশ ওষুধের কাঁচামাল (এপিআই) রফতানি করেও বছরে ২০০ কোটি ডলার আনতে পারে। এজন্য এ শিল্পটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রুত কিছু সমস্যার সমাধান জরুরি বলে এপিআই শিল্পের উদ্যোক্তারা মনে করেন।

বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প বর্তমানে নিজেদের প্রয়োজনের প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন করে বিদেশ থেকে এপিআই আমদানি করে। এর বিপরীতে বাংলাদেশের কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি প্রয়োজনের নিরিখে কিছু এপিআই উৎপাদন করে। শুধু ওষুধ কোম্পানিগুলো নয়, এর বাইরে কয়েকটি এপিআই শিল্প গড়ে উঠেছে যারা নিজেরা ওষুধ উৎপাদন করে না। তারা বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রয়োজন অনুযায়ী এপিআই উৎপাদন করে। এই এপিআই উৎপাদনকারীরা আবার বিদেশেও কিছু এপিআই রফতানি করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ২০১৯ সালে শুধু এপিআই উৎদানকারীরা এক কোটি ৮০ লাখ ডলারের এপিআই রফতানি করতে সক্ষম হয়েছে।

এ ব্যাপারে শুধু যারা এপিআই উৎপাদন করে তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এপিআই অ্যান্ড ইন্টারমিডিয়ারিজ ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএআইএমএ) সভাপতি এস এম সাইফুর রহমান ওষুধের কাঁচামাল শিল্পের সঙ্কট ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বলেন, দেশে বর্তমানে ১৫টি কোম্পানি ৭০ ধরনের ওষুধের এপিআই তৈরি করে। সব ধরনের ওষুধ উৎপাদনের জন্য প্রায় এক হাজার এপিআই প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো মাত্র ৭০ ধরনের এপিআই উৎপাদন করে। বাকি প্রায় ৯৩০ ধরনের এপিআই আমদানি করা হয়। এটা একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। মানুষকে সুস্থ থাকতে হলে ওষুধ লাগবেই, আর ওষুধ উৎপাদন করতে হলে এপিআই লাগবেই। অতএব এই শিল্পটিতে সরকার মনোযোগ দিলে এবং সরকারের নীতি সহায়তা ও আর্থিক প্রণোদনা পেলে এসব কাঁচামালের অধিকাংশই দেশেই উৎপাদন সম্ভব। এই শিল্পটি দেশীয় ফার্মা কোম্পানিগুলোর চাহিদা মিটিয়ে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ২০০ কোটি (দুই বিলিয়ন) ডলারের কাঁচামাল রফতানি করার সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।

সাইফুর রহমান বলেন, শিল্প স্থাপনে বহুবিদ সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। আমরা সব সমস্যার কথা বলছি না, সম্ভাবনাময় এই শিল্পটি বাংলাদেশের ফার্মা শিল্পের মতোই বেড়ে ওঠতে পারে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে ট্যাক্সও ভ্যাটবিষয়ক কিছু সুবিধা আমরা চাই। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশের ভেতরে কিছু উৎপাদন করতে পারলে ট্যাক্স ও ভ্যাট এক্সেম্পশান (মুক্তি) দেয়া হয়। আমরা সেই সুবিধাটিই চাচ্ছি, তাহলে আমাদের এপিআই শিল্পটি দাঁড়িয়ে যেতে পারবে এবং আমরা প্রচুর রফতানি করতে পারব। এ ব্যাপারে সরকারি শর্ত মেনে চলতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। একই সাথে বাংলাদেশ সংস্কার কমিশন এপিআইকে ‘জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু’ হিসেবে দেখতে বলেছে। আমরা সরকারের কাছে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশটিও বাস্তবায়নের দাবি করি।

সাইফুর রহমান বলেন, আমাদের প্রতিবেশি দেশটি এপিআই শিল্পকে সহায়তা করার জন্য প্রোডাকশন লিঙ্ক ইনসেনটিভ (পিএলআই) হিসেবে ২১ হাজার কোটি রুপি দেয়ার ঘোষণা করেছে। আমরাও এমন কিছু ইনসেনটিভ চাই। তাহলে এপিআই শিল্পটি দাঁড়িয়ে যেতে পারবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলে বাংলাদেশ অনেক এপিআই সহজে ও সস্তায় কিনতে পারবে না। বিদেশ থেকে অনেক দামে এপিআই কিনে নিয়ে এলেও এখানকার সস্তা ওষুধও তখন মানুষ পাবে না, বহুমূল্যে ওষুধ কিনে খেতে হবে। এ ক্ষেত্রে সহজ সমাধান হলো, ‘নিজের দেশেই প্রয়োজনীয় এপিআই উৎপাদনের সক্ষমতা গড়ে তোলা।’ তাহলে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন হলেও দেশীয় ওষুধ সস্তায় কিনতে পারবে মানুষ।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রফতানি হয়েছে ১৩৪ মিলিয়ন ডলার। তবে সামগ্রিকভাবে বছরে আনুমানিক ২১৩ মিলিয়ন ডলার রফতানি হয়ে থাকে। এপিআই উৎপাদন ও রফতানি বাড়লে ভবিষ্যতে শুধু কাঁচামাল হিসেবে দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের এপিআই রফতানি করা সম্ভব।

উদ্যোক্তারা বলছেন, মুন্সীগঞ্জের গাজারিয়ায় এপিআই ইন্ডাস্ট্রি পার্কে বেশ কোম্পানিকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ উদ্যোগ দেশের এপিআই উৎপাদনের সমতা ও আরঅ্যান্ডডি কার্যক্রমকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করবে।

দেশের শীর্ষ কয়েকটি ফার্মা কোম্পানি ইউএস এফডিএ, ইইউ জিএমপি, ইউকে এমএইচআরএ, অস্ট্রেলিয়ান টিজিএর সার্টিফিকেট অর্জন করেছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এনসিএল ম্যাচিউরিটি লেভেল-৩ অর্জনের পথে রয়েছে।

বাংলাদেশের এপিআই শিল্পে বর্তমানে স্থানীয় উৎপাদন সীমিত হলেও, নির্ধারিত নীতি সহযোগিতা, শিল্প পার্ক, আরঅ্যান্ডডি ও আন্তর্জাতিক মানের অ্যাক্রিডিটেশন অর্জনের মাধ্যমে কয়েক বছরের মধ্যেই বছরে দুই বিলিয়ন ডলারের এপিআই রফতানি অর্জন সম্ভব বলেও উদ্যোক্তা আশা প্রকাশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে সফলতার জন্য দরকার, শিল্প পার্ক ও শক্তিশালী উৎপাদন চেইন দ্রুত বাস্তবায়ন। ট্রিপস পরবর্তী আইনি কাঠামো তৈরি, পেটেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও গবেষণা সমর্থন।