আবহাওয়ার তারতম্যে হাওরের প্রাণে প্রকৃতির বিষণ্ণতা

এক সময় যে হাওর ছিল জীববৈচিত্র্যের অনন্য ভাণ্ডার, এখন সেখানে নেমেছে নিস্তব্ধতা। প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ব্যাঘাত, আবহাওয়ার চরম তারতম্য ও মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কারণে হাওরের প্রাণচক্র আজ গভীর সঙ্কটে।

আলি জামশেদ, নিকলী (কিশোরগঞ্জ)
Printed Edition
নিকলীর হাওরে এই স্থানে বসে পর্যটকরা দৃশ্য দেখেন
নিকলীর হাওরে এই স্থানে বসে পর্যটকরা দৃশ্য দেখেন |নয়া দিগন্ত

কিশোরগঞ্জসহ বৃহত্তর হাওরাঞ্চলের প্রকৃতি যেন এখন আর আগের মতো নেই। এক সময় যে হাওর ছিল জীববৈচিত্র্যের অনন্য ভাণ্ডার, এখন সেখানে নেমেছে নিস্তব্ধতা। প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ব্যাঘাত, আবহাওয়ার চরম তারতম্য ও মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কারণে হাওরের প্রাণচক্র আজ গভীর সঙ্কটে।

সরেজমিন দেখা গেছে, নিকলী, বাজিতপুর, অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন ছাড়াও সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোণার হাওরগুলোতেও একই চিত্র। স্থানীয়দের ভাষায়, ‘বন্যা যেমন নেই, মাছও আর নেই। জলবায়ু পরিবর্তন ও নদীপথের পরিবর্তনে একদিকে অকাল বন্যার ভয় কমেছে, অন্যদিকে শুকনো মৌসুমে পানি না থাকায় হাওরের মৎস্যসম্পদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, ভারতের মেঘালয় প্রদেশের সীমান্তবর্তী নদীগুলোর খনন ও গতিপথ পরিবর্তনের কারণে পানি এখন অন্য দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে হাওরে পানির প্রবাহ কমে গিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে জলজ প্রাণীর প্রজনন সঙ্কট। অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির চক্র, তাপমাত্রার অস্বাভাবিক ওঠানামা এবং কৃষিতে কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার হাওরের মাটির উর্বরতাও কমিয়ে দিয়েছে।

হাওরাঞ্চলে এসিড বৃষ্টির উপস্থিতি বেড়েছে, যা মাছের জন্য বিষাক্ত। সালফার ও নাইট্রোজেন অক্সাইড বৃষ্টির সাথে মিশে সালফিউরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিড তৈরি করছে, এতে পানির পিএইচ কমে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে।

নিকলীর আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র অবজারভার জানান, বাতাসে সিসা ও কার্বনডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ুর ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, আশপাশের শিল্পাঞ্চল ও যানবাহনের ধোঁয়া এ অঞ্চলের বায়ুদূষণের মূল কারণ। বৃক্ষনিধন ও বৃষ্টিপাতের অনিয়মও প্রভাব ফেলছে হাওরের আবহাওয়ায়।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘হাওরে পানি আসতে দেরি হচ্ছে, নদীপথ ভরাট হয়ে গেছে। এতে প্রজনন মৌসুমে মাছের বিস্তার ব্যাহত হচ্ছে।’ অপরিকল্পিত বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ মাছের চলাচল রুদ্ধ করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

অন্যদিকে পাউবো কর্মকর্তারা মনে করছেন, নদীর গতিপথ পরিবর্তনে বন্যার ভয় কিছুটা কমলেও, এ কারণে হাওর হারিয়েছে তার প্রাণশক্তি।

প্রকৃতির এই তারতম্য শুধু প্রাণিজগত নয়, মানুষের জীবিকাকেও বিপন্ন করছে। মাছের অভাবে হাওরের জেলেরা পেশা বদলাচ্ছেন, কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, জলজ উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় জীবনের সজীবতায় ভরা যে হাওর, আজ সেখানে বইছে নীরবতার হাওয়া।

স্থানীয়দের প্রশ্ন, ‘যদি এখনই প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ না নেয়া হয়, তবে আগামী প্রজন্ম কি কখনও হাওরের আসল সৌন্দর্য দেখতে পাবে?’