সাক্ষাৎকার : মোস্তফা কামাল পলাশ

ভূ-অভ্যন্তরের মুভমেন্ট নজরদারির জন্য ফল্টলাইনে জিপিএস বসানো দরকার

হামিম উল কবির
Printed Edition
সাক্ষাৎকার : মোস্তফা কামাল পলাশ
সাক্ষাৎকার : মোস্তফা কামাল পলাশ

বাংলাদেশে ভূমিকম্প পরিমাপ করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে মেশিন নেই। ফলে ভূমিকম্পের সঠিক মুভমেন্ট জানার জন্য বিদেশীদের ওপরই নির্ভর করতে হয়, যারা দূর থেকে ভূমিকম্পের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। রিখটার স্কেলে ৩ অথবা এর চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প না হলে আমরা বুঝতে পারি না যে ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু জিপিএস যেটা গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম হিসেবে পরিচিত সেই মেশিনে ১ থেকে ২ মাত্রার ভূমিকম্প এবং ভূমির মুভমেন্ট কোন দিকে সেটা ধরা পড়ে। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস না পেলেও ভূ-অভ্যন্তরে ভূমির নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করে ভূ-অভ্যন্তরে কী পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় হয়ে আছে সেটার কিছুটা হলেও অনুমান করা যেতে পারে। ফলে আগে-ভাগেই একটা সতর্কতা অবলম্বন করা যেতে পারে।

গতকাল সোমবার কানাডার সাসকাচুয়ান ইউনিভার্সিটির পিএইচডির গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ টেলিফোনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। তিনি আবহাওয়া নিয়ে সাসকাচুয়ান ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করছেন। উল্লেখ্য, ভূমিকম্প আবহাওয়া বিজ্ঞানের একটি অংশ। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরণ-

নয়া দিগন্ত : বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পকে কিভাবে দেখছেন?

মোস্তফা কামাল পলাশ : বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিনটি ফল্টলাইন বা চ্যুতি রয়েছে। এর মধ্যে টাঙ্গাইল-জামালপুরের মধুপুর ফল্টলাইন অন্যতম। অন্য দু’টি ফল্টলাইনের একটি ডাউকি এবং অন্যটি আরাকান ফল্টলাইন। আরাকান ফল্টলাইনের বিস্তৃতি দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মাইল হলেও মধুপুর ফল্টলাইনটি খুব বেশি বিস্তৃত নয়। এই মধুপুর ফল্টলাইনটি আড়াআড়িভাবে উপর থেকে নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর মধুপুর ফল্টলাইনের অংশ। এই ফল্টলাইনের একটি অংশে গত ২১ নভেম্বর ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে গেল।

নয়া দিগন্ত : এ বিষয়ে আরেকটি বিস্তারিত বলুন।

মোস্তফা কামাল পলাশ : বলছিলাম ফল্টলাইনের কথা। সাধারণত ফল্টলাইনের যে অংশে বেশি শক্তি সঞ্চিত হয় এবং যে অংশটি বেশি দুর্বল সেই অংশেই ভূমিকম্প হয়; অর্থাৎ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বা এপিসেন্টার বলা হয়ে থাকে। যেখানে এপিসেন্টার সেখানেই অথবা এর আশপাশে আফটার শক হিসেবে আরো কিছু ভূমিকম্প হতে পারে। পরদিন নরসিংদীতে আরো দু’টি অপেক্ষাকৃত কম মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে গেল, এটাকে আফটার শক বলা যেতেই পারে।

নয়া দিগন্ত : আরো ভূমিকম্পের শঙ্কা কি আছে?

মোস্তফা কামাল পলাশ : হয়তো দেখা যাবে পরবর্তী ভূমিকম্পটি একই ফল্টলাইনের অন্য কোনো দুর্বল অংশে হতে পারে। এটা বলা যায় যে, ফল্টলাইনগুলোতে এতদিনে বেশ শক্তি জমা হয়ে গেছে সেটা কোনো না কোনো অংশে প্রকাশ পেতে পারে ভূমিকম্প আকারে।

২০১৫ সালের জুলাই মাসে বিখ্যাত নেচার জার্নালে হিমালয় অঞ্চলে ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রজার বিলহাম একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন ‘সিসমোলজি : রাইজিং কাঠমান্ডো’ নামে। তিনি ওই প্রবন্ধে বলেন, হিমালয় পর্বতের নেপাল সন্নিহিত অঞ্চলে বড় মাপের যে ভূমিকম্পটি হওয়ার কথা তা এপ্রিল মাসে (২০১৫ সালের এপ্রিল) সংঘটিত ৭.৮ মাত্রার যে ভূমিকম্পটি হয়ে গেছে সেটা না। ওই অঞ্চলে এর চেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার মতো পর্যাপ্ত শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। যে কোনো সময় ওই অঞ্চলে ৮-৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে যেতে পারে।

নয়া দিগন্ত : অধ্যাপক রজারের পূর্বাভাসের বিষয়ে বিস্তারিত বলবেন কি? প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?

মোস্তফা কামাল পলাশ : অধ্যাপক রজারের পূর্বাভাস অনুসারে সেই বড় ভূমিকম্পটি নেপালেই হোক বা ডাউকি ফল্টলাইনেই হোক; সেটার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশেও পড়তে পারে। বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

নয়া দিগন্ত : ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া যায় কি না?

মোস্তফা কামাল পলাশ : ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দৈনন্দিন আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো না। কোনো এলাকায় ভূমিকম্পের সম্ভাব্যতা বৈজ্ঞানিকরা সেই এলাকায় ভূপ্রকৃতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত করেই বলতে পারেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট সময় বলতে পারেন না। কোনো স্থানে ভূমিকম্প একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর হয়ে থাকে যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় রিটার্ন ইন্টাভেল বলা হয়। পেলিওসাইমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো স্থানে ভূমিকম্পের রিটার্ন ইন্টাভেল সম্বন্ধে কাছাকাছি একটা সময় নির্ধারণ করতে পারেন বৈজ্ঞানিকরা। ভূমিকম্প প্রবণ ১০টি স্থানের অবস্থান ও কোনো স্থানে ভূমিকম্প হলে সেই স্থানে একটি প্লেট অন্যটির উপর উঠে যেতে পারে তা জিপিএস ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে বলে দেয়া যায়। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রজার হিমালয় অঞ্চলের ৫০০ বছরের ভূমিকম্পের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে ১৫টি অঞ্চলে ভাগ করেছেন। সেই ১৫টি অঞ্চলের মধ্যে ১০টি অঞ্চল শনাক্ত করেছেন যেগুলোতে ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। কারণ সেই স্থানগুলোতে ভূমিকম্প হওয়ার মতো এতদিনে যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি সঞ্চিত হয়েছে।

নয়া দিগন্ত : প্লেটগুলো বিশেষ করে ইন্ডিয়ান প্লেটটির বর্তমানের অবস্থা কী যেখানে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি দাঁড়িয়ে আছে?

মোস্তফা কামাল পলাশ : আজ থেকে কয়েক শ’ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর সবগুলো প্লেট কাছাকাছি ছিল অ্যাসথেনোসয়োরে কনবেভনশনের (পরিচলন পদ্ধতিতে তাপ প্রবাহ) ফলে কন্টিনেন্টাল ক্রাস্ট বা প্লেটগুলো একটি অন্যটি থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছে। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে টেকটোনিকস বলে। আজ থেকে ৫০ মিলিয়ন বছর আগে ইন্ডিয়ান প্লেট ছিল ভারত মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত একটি দ্বীপের মতো। গত ৫০ মিলিয়ন বছর ধরে এটি ক্রমাগত ইউরেশিয়ান প্লেটের দিকে এগোচ্ছে। বর্তমানে ইন্ডিয়ান প্লেট প্রতি বছর ৪ থেকে ৫ সেন্টিমিটার করে ইউরেশিয়ান প্লেটের দিকে এগিয়ে আসছে।