ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে থাকা ব্যাংক লকার থেকে উদ্ধার হওয়া বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালঙ্কার ঘিরে নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাম্প্রতিক বক্তব্য। দুদকের দাবি অনুযায়ী, আগ্রণী ব্যাংকের লকারে পাওয়া ৮৩২ দশমিক ৫১ ভরি স্বর্ণালঙ্কার সম্পূর্ণভাবে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত মালিকানাভুক্ত নয়- এর একটি অংশ তার বোন শেখ রেহানা এবং কন্যা সাইমা ওয়াজেদ পুতুলের।
দুদক মহাপরিচালক মো: আখতার হোসেন গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের জানান, লকার নম্বর ৭৫১-এ পাওয়া গেছে ৪২২ দশমিক ২৬ ভরি সোনা, যা শেখ হাসিনা এবং পুতুলের যৌথ নামে নিবন্ধিত।
অন্য দিকে লকার নম্বর ৭৫৩-এ পাওয়া গেছে ৪১০ দশমিক ২৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার যৌথ নামে খোলা।
ঘোষিত সম্পদ বনাম বাস্তব উদ্ধার : বড় ফারাক : দুদকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে সম্পদ বিবরণীতে শেখ হাসিনা তিনটি লকারের কথা উল্লেখ করেছিলেন- দু’টি আগ্রণী ব্যাংকে এবং একটি পূবালী ব্যাংকে। কিন্তু পূবালী ব্যাংকের লকার খুলে পাওয়া গেছে শুধু একটি খালি পাটের বস্তা।
অন্য দিকে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে দাখিল করা হলফনামায় শেখ হাসিনা নিজের নামে মাত্র ১৩ দশমিক ২৫ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার ঘোষণা করেছিলেন।
এখানেই তৈরি হয়েছে বড় প্রশ্ন : ঘোষিত সম্পদের সাথে উদ্ধারকৃত স্বর্ণের পরিমাণে বিপুল অমিল কেন?
যৌথ মালিকানার লকারে ব্যক্তিগত সম্পদ কিভাবে এবং কত বছর ধরে মজুদ ছিল?
এসব সম্পদের প্রকৃত উৎস কী?
‘চিহ্নাঙ্কিত’ গয়না : মালিকানা নির্ধারণে নতুন জটিলতা : দুদকের মহাপরিচালক জানান, উদ্ধার করা স্বর্ণালঙ্কারের অনেকগুলোতে নির্দিষ্ট চিহ্ন রয়েছে, যা মালিকানা বোঝায়।
তার ভাষায় : কিছু অলঙ্কার শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত, কিছু তার মেয়ে এবং বোনের নামে চিহ্নিত। প্রতিটি সামগ্রী আলাদাভাবে যাচাই করা হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই তথাকথিত ‘মার্কিং সিস্টেম’ তদন্তকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। কারণ প্রশ্ন উঠেছে- এই চিহ্নগুলো কখন বসানো হয়েছে? ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোন নথির ভিত্তিতে যৌথ মালিকানা অনুমোদন করেছে? এত বড় পরিমাণ স্বর্ণ কি কর, সম্পদ বিবরণী ও মানিলন্ডারিং নীতিমালার আওতায় সঠিকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছিল?
ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে : এই ঘটনাকে শুধু রাজনৈতিক সম্পদের প্রসঙ্গ হিসেবে দেখছেন না অর্থনীতি সংশি¬ষ্টরা। তারা বলছেন, এখানে ব্যাংকিং ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ, কেওয়াইসি (কণঈ), লকার মনিটরিং এবং উচ্চমূল্যের সম্পদ সংরক্ষণের স্বচ্ছতা নিয়েও বড় প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে : যৌথ লকার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাড়তি নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত ছিল। এত বড় সম্পদ বছরের পর বছর নজরদারির বাইরে থাকা অস্বাভাবিক। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদারক ব্যবস্থার দুর্বলতা স্পষ্ট।
রাজনৈতিক সম্পদের স্বচ্ছতা, আরো বড় সঙ্কেত : এই ঘটনা এমন এক সময়ে সামনে এলো, যখন দেশজুড়ে পতিত সরকারের সময়ে অর্জিত সম্পদের স্বচ্ছতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় তদন্ত জোরালো হচ্ছে।
বিরোধী বিশ্লেষকদের মতে, এটি শুধুই একটি লকারের ঘটনা নয়, বরং এটি ইঙ্গিত করছে- ক্ষমতার সময় রাজনৈতিক পরিবারের সম্পদ কিভাবে গোপন রাখা হয়েছে, সম্পদ ঘোষণার ব্যবস্থায় কতটা ফাঁকফোকর রয়েছে, রাজনৈতিক পদে থাকা ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধাভোগী আর্থিককাঠামো কিভাবে কাজ করেছে।
সামনে কী : দুদক জানিয়েছে, প্রতিটি অলঙ্কার আলাদাভাবে ফরেনসিক যাচাই করা হবে, যার মধ্যে থাকবে-
প্রকৃত মালিক নির্ধারণ, সম্পদ ঘোষণার সাথে মিল পরীক্ষা, কর ও আয়করসংক্রান্ত নথি যাচাই, ব্যাংকিং রেকর্ড পর্যালোচনা।
ব্যাংকের এই দুই লকার শুধু স্বর্ণালঙ্কারের ভাণ্ডার নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে ক্ষমতা, সম্পদ এবং স্বচ্ছতার মধ্যে দীর্ঘদিনের অস্বচ্ছ দেয়ালের প্রতীক। প্রশ্ন এখন শুধু- এই সোনা কার? প্রশ্ন হলো- এই সম্পদ ব্যবস্থা এতদিন কিভাবে আড়ালে ছিল?



