ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীকেই প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করছে বিএনপি। সাম্প্রতিক সময়ে দলটির রাজনৈতিক ও নির্বাচনমুখী তৎপরতায়ও এটা লক্ষ করা গেছে। জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সাথে জোটে থেকে রাজনীতি ও নির্বাচন করলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে দল দু’টি এখন কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায়। রাষ্ট্র সংস্কার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে যেমন মতপার্থক্য রয়েছে, তেমনি রাজনীতির মাঠেও তাদের মধ্যে রয়েছে দূরত্ব। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে তারা জামায়াতে ইসলামীকেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে।
এ দিকে জামায়াত ইতোমধ্যে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে মাঠে প্রচারণায় থাকায় তফসিলের আগেই এবার দুই-তৃতীয়াংশ আসনে একক প্রার্থীকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। চলতি মাসের মধ্যে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে চায় দলটি। উদ্দেশ্য, নির্বাচনী প্রচারণায় যাতে তারাও মাঠে পিছিয়ে না পড়ে। অবশ্য তফসিলের পর সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে বিএনপি। দলটির দায়িত্বশীল সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
১৯৯৯ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় জোট গঠন করা হয়। জোটের বাকি তিনটি দল ছিল জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট। পরে জোটগতভাবে ২০০১ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জয়লাভ করে বিএনপি। এরপর বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত সরকারে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে মন্ত্রিসভায়ও স্থান দেয়া হয়।
পরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলের সাথে আরো ১২টি দল যোগ হয়ে ‘১৮ দলীয় জোট’ নামে নতুন এক মোর্চা গঠনের ঘোষণা দেন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া, যা পরে ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর ২০ দলীয় জোট অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেয় বিএনপি। এরপর ২০ দলের শরিকরা একাধিক জোট গঠন করে ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়।
ফ্যাসিবাদবিরোধী ওই লড়াইয়ে জামায়াত শুরুতে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে শামিল ছিল। প্রথম দিকে যুগপৎভাবে দু’টি কর্মসূচিও পালন করেছিল দলটি। পরে দলীয় একক কর্মসূচি নিয়ে পুরো আন্দোলনজুড়ে রাজপথে সক্রিয় ছিল জামায়াত। তবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নির্বাচনের মাঠে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে আত্মপ্রকাশ করে জামায়াতে ইসলামী। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে দু’টি দলের নেতৃত্বেই পৃথক জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
এ দিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতিসহ নানা ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে যেমন মতপার্থক্য রয়েছে। তবে এটি মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের অভিমত। আর রাজনৈতিক বাদানুবাদ বাদ দিয়ে রাজনীতি ও নির্বাচনের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বীর বিষয়টিকে বিএনপি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। বিএনপি মনে করে, নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক হতে হলে প্রতিটি দলেরই আলাদা আলাদা কৌশল অবস্থান থাকবে। জনগণ সিদ্ধান্ত নিবে, তারা কাকে বেছে নিবে? এমন অবস্থায় জামায়াতকে নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির প্রত্যাশা, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের ভোট ও ভালোবাসায় বিজয়ী হয়ে তারা সরকার গঠন করবে।
জামায়াত প্রসঙ্গে সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ইলেকশন হলে তো প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতেই পারে। এতে উদ্বেগের কী আছে? বিএনপি তো আগেও নির্বাচন করেছে। প্রতিযোগিতা করেই নির্বাচন করেছে। সুতরাং উদ্বেগের কিছু নেই তো।
জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে সারা দেশে তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। তাদের প্রার্থীরা এখন মাঠে রয়েছেন এবং প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। অন্য দিকে বিএনপির প্রার্থিতা এখনো চূড়ান্ত না হলেও সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠে আছেন। প্রার্থিতা চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে এবার প্রার্থী চূড়ান্ত করবে দলটি। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ইমেজ, এলাকায় জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্যতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে পাঁচটি জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। নেয়া হয়েছে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদেরও মতামত। তবে সব মিলিয়ে সারা দেশে দেড় শতাধিক আসনে তেমন কোনো জটিলতা দেখছেন না বিএনপির হাইকমান্ড। অর্থাৎ এসব আসনে প্রার্থিতা মোটামুটি নির্ধারিত। এমন অবস্থায় ‘জটিলতাপূর্ণ’ আসনগুলো যেখানে একাধিক প্রার্থী রয়েছে এবং গ্রুপিং বিদ্যমান, সঙ্কট নিরসনে এমন প্রায় এক শ’ আসনে সাংগঠনিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতাকে সাংগঠনিক বিভাগভিত্তিক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা কাজ করে যাচ্ছেন। আসনভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থীকে কেন্দ্রে ডেকে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে ‘একক প্রার্থী’ দেয়ার কথা জানিয়ে তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। অন্যথায় কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এ দিকে জামায়াতের একক প্রার্থীরা ইতোমধ্যে মাঠে থাকায় বিএনপির তৃণমূলের নেতারা মনে করছেন, তারা পিছিয়ে পড়ছেন। তাই বিএনপির মাঠ পর্যায়ের এসব নেতারা তাড়াতাড়ি প্রার্থিতা চূড়ান্তের বিষয়টির সুরাহা চায়। প্রতিটি আসনে দলটির দুই থেকে তিন কিংবা আরো বেশি প্রার্থী রয়েছেন। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুরোদমে নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়ার জন্য কেন্দ্রকে তাগাদা দিচ্ছেন।
জানা গেছে, দলীয় প্রার্থিতা চূড়ান্ত করার পাশাপাশি জামায়াতের নির্বাচনী কৌশল সম্পর্কেও খোঁজখবর রাখছে বিএনপি। জামায়াতের ভোটারকেন্দ্রিক প্রচারণা, নারী ভোটারকেন্দ্রিক প্ল্যান-পরিকল্পনা বিষয়ে মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে দলটি। এ ছাড়া বিএনপির সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও এ সম্পর্কে কেন্দ্রকে অবহিত করছেন।
দলটি মনে করছে, তারা মাঠে স্বচ্ছ ইমেজসম্পন্ন গ্রহণযোগ্য প্রার্থী দিতে সক্ষম হবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনী মাঠে তাদের অবস্থান সুসংহত হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। তা ছাড়া বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অত্যন্ত সক্রিয় রয়েছে। ফলে আলাদা করে নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রয়োজন হবে না। নির্বাচনের জন্য আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আর মনোনয়ন দেয়ার ব্যাপারে প্রক্রিয়া চলছে। তবে কাউকে এখনো চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন দেয়া হয়নি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি নতুন পরিস্থিতিতে বিএনপি এখন নির্বাচন করবে। নির্বাচনে যাওয়ার পরে আমরা দেখতে পাব- কারা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। যারাই আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হবে, তাদের আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখব।