সাক্ষাৎকার : জাভেদ সিরাজি

ইরানিদের মধ্যে পারমাণবিক বোমার দাবি বাড়ছে

জাভেদ সিরাজি নারায়ণগঞ্জ থেকে ইংরেজি মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমার্সে ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৭ সালে স্বদেশ ইরানে ফিরে যান। চর্চার অভাবে বাংলা বলা কষ্টকর হলেও কেউ বাংলা বললে বুঝতে পারেন।

সৈয়দ মূসা রেজা
Printed Edition
জাভেদ সিরাজি
জাভেদ সিরাজি |সংগৃহীত

তেহরানের ব্যবসায়ী জাভেদ সিরাজি নয়া দিগন্তকে দেয়া টেলিফোন সাক্ষাৎকারে অকপটে স্বীকার করেন, তেহরানের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকলে কেউই ইরান আক্রমণের দুঃসাহস দেখাতো না। তিনি আরো বলেন, ইরানের মানুষের মধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরির দাবি বাড়ছে। সাক্ষাৎকারের প্রথমেই জানান, ঢাকায় তার শিকড় রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ইংরেজি মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমার্সে ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৭ সালে স্বদেশ ইরানে ফিরে যান। চর্চার অভাবে বাংলা বলা কষ্টকর হলেও কেউ বাংলা বললে বুঝতে পারেন। যুদ্ধের গোটা সময়ই তিনি তেহরান ছিলেন। জানালেন, তেহরানের জীবনযাত্রা এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

নয়া দিগন্ত : এখন যুদ্ধ চলছে না, তারপর ইরান, বিশেষ করে তেহরানের অবস্থা কী?

জাভেদ সিরাজি : ইরান, বিশেষ করে তেহরানের অবস্থা স্বাভাবিক। রাস্তাঘাটে ভিড় বাড়ছে। লোকজন যারা তেহরান ছেড়ে চলে গিয়েছিল তারা ফিরছে। গোটা ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবেন, ইরানিরা সব সময়ই প্রচণ্ড সহনশীল এবং প্রাণোচ্ছল। ৪০ থেকে ৪৫ বছর আগে, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্তও তারা আট বছরের যুদ্ধ দেখেছে। কাজেই যুদ্ধ নতুন কিছু না। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ইরানিদের আছে। এবারের যুদ্ধও তাদের কাছে খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না। জীবন স্বাভাবিক গতিতে চলতে হবে এবং স্বাভাবিক গতিতেই চলছে।

নয়া দিগন্ত : এ যুদ্ধের কী ফলাফল দেখতে পাচ্ছেন আপনি?

সিরাজি : ব্যাপারটি হলো, ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিম ইউরোপের মতো শক্তির মদমত্ত দেশগুলো বাকি দুনিয়ার প্রতি ঔপনিবেশিক মনোভাব পোষণ করে। আগ্রাসীকে কখনও নিন্দা জানানো হয় না। বরং তারা দাবি করে, আত্মরক্ষার জন্যই এমনটি করা হয়েছে। তাদের মতো কোনো দেশ যখন আগ্রাসন চালায় তারা দাবি করে এটি নিছক আত্মরক্ষার খাতিরে করা হয়েছে। কিন্তু অন্যদিক থেকে একই কাণ্ড ঘটলে যেমন, ইউক্রেনে রাশিয়া আক্রমণ করলে তারা একযোগে বলে ওঠে রাশিয়া হলো আগ্রাসী। ইরানে যখন ইহুদিবাদী ইসরাইল হামলা করল তারা সমস্বরে বলে উঠল, কেবল আত্মরক্ষার খাতিরেই এ হামলা চালানো হয়েছে।

নয়া দিগন্ত : একে কি পশ্চিমাদের দ্বিচারী নীতি বলা যাবে না?

সিরাজি : (উচ্ছ্বসিত গলায় বলে ওঠেন) জি। জি। একেবারে ঠিক কথাটিই বলেছেন। এটা দ্বিচারী নীতি। গোটা ইতিহাসজুড়ে এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায়। ঔপনিবেশিক আচরণ, তার আগে ছিল ইসলামবিরোধী ক্রুসেড- এসব একই কাহিনী। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা এমন সব নামে আগ্রাসীকে মদদ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র্র এবং পশ্চিম ইউরোপ। তাদের মধ্যে দ্বিচারী নীতি দেখতে পাবেন। তারা সবাই মুনাফিক।

নয়া দিগন্ত : ইরানে মানুষের মধ্যে নানা মতভেদ রয়েছে। যুদ্ধের পর এই মতভেদ কি বেড়েছে?

সিরাজি : কী ঘটেছে তা ব্যাখ্যা করছি। ইরানে মানুষের মধ্যে অনেক বিষয়েই মতভেদ আছে। কিন্তু বাইরে থেকে ইরানের ওপর যখন হামলা করা হলো তখন কিন্তু ইরানের সব মানুষ ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে গেল। তখন কি হলো জানেন? সবাই একযোগে দেশের জন্য দাঁড়িয়ে গেল। তারা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল। এই আগ্রাসন ইরানের মানুষকে কার্যত একতাবদ্ধ করেছে। ইরানের মানুষের মধ্যে মতভেদ থাকলেও এই আগ্রাসনের প্রতি সবার মনোভাব এক। তারা সবাই এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে।

নয়া দিগন্ত : ইরানের মানুষ কি এখন পারমাণবিক বোমা তৈরির পক্ষে একমত?

সিরাজি : অবশ্যই তেহরানের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকলে কেউই ইরান আক্রমণের দুঃসাহস দেখাতো না। এই পারমাণবিক বোমা না থাকায় ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তানে ওরা বোমা ফেলেছে। আগ্রাসন চালিয়ে দখল করেছে। ওই দিকে উত্তর কোরিয়ার কাছে পারমাণবিক বোমা থাকায় কেউ দেশটি আক্রমণের সাহস করে না। দেশটির বিরুদ্ধে কেউ আঙুল তুলতেও সাহস পায় না। ইরানে গত ২০ দিন ধরে যা হয়েছে তারপর ইরানের মানুষ দাবি তুলেছে, না; আমাদের ওই জিনিস থাকতে হবে। আপনি একটু খেয়াল করে দেখুন গত প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে এসব মানুষ বিশেষ করে ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করে আসছেন যে, আগামী মাসেই ইরানের কাছে পারমাণবিক বোমা এসে যাবে। আগামী মাসেই ঘটবে এমনটা। গত ২৫ বছর ধরে তারা এ কথা বলছে। কিন্তু ইরান পারমাণবিক বোমা বানানোর কোনো চেষ্টা করেনি। যদি করত তা হলে এতদিনে তাদের হাতে বোমা থাকত। ইরান সরকারের নীতিমালা হলো পারমাণবিক বোমা বানাবে না। কিন্তু ইরানের জনগণ এখন জোরালো গলায় পারমাণবিক বোমার দাবি জানাচ্ছে। ইরানের সরকার এ বিষয় সিদ্ধান্ত নেবে- দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়। ইরান সরকার ঠিক করবে পারমাণবিক বোমা থাকবে কী থাকবে না। পারমাণবিক বোমার জন্য গবেষণা চালাবে কী চালাবে না। এ বিষয়টি সরকারই ঠিক করবে। এটা নীতি নির্ধারণের বিষয়, সরকার সব কিছু খতিয়ে দেখবে তার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিবে।

নয়া দিগন্ত : ইরানের জীবনযাত্রা কি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে?

সিরাজি : হ্যাঁ, হ্যাঁ জীবনযাত্রা এরই মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় ভিড় বাড়ছে। যুদ্ধের সময় গাড়ি চলাচল খুবই কমে গিয়েছিল। ইরান একটি বড় দেশ এবং অনেকেই তেহরান ছেড়ে বাইরে বা কাস্পিয়ানের তীরে চলে গেছিল। তাদের প্রায় সবাই ফিরে এসেছে।

নয়া দিগন্ত : যুদ্ধের সময় আপনি কি তেহরানে ছিলেন না বাইরে গিয়েছিলেন?

সিরাজি : না, না, আমি তেহরানেই ছিলাম। আমি কোথাও যাইনি। আমরা তেহরান নগরীতেই ছিলাম।

নয়া দিগন্ত : আপনার দৃষ্টিতে যুদ্ধের সময় ইরানে যে ধ্বংসলীলা ঘটেছে তা কাটিয়ে উঠতে বা ঠিকঠাক করতে কত দিন লাগবে?

সিরাজি : ছয় মাস থেকে এক বছর কিংবা দুই বছরের মধ্যে মেরামত করে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে। ইসরাইলের বিমান যখন হামলা করতে এসেছে তখন তারা আধা বা এক টন বোমা বহন করতে পেরেছে। অন্যদিকে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র মেরেছে। তাতে দেড় টন থেকে দুইটন ওয়ারহেড বা বোমা ছিল। এটা যেখানে আঘাত করেছে ইসরাইলের সেই লক্ষ্যবস্তুতে ভয়াবহ ধ্বংসলীলা ঘটেছে। সেনাঘাঁটি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেখানেই হোক ইরান কঠিন আঘাত করেছে। ইসরাইল, এরচেয়ে বেশি না হলেও আধা কিলোমিটারব্যাপী ধ্বংস হয়ে গেছে। দেড় টন থেকে দুই টন বিস্ফোরক সেই সাথে যোগ হয়েছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের গতি ও ওজন। ইসরাইল যুদ্ধ বিরতি মেনে নেয়ার অন্যতম কারণ এটি। কারণ তাদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল ব্যাপক। ইসরাইল আকারে বড় নয়, ছোট। জনসংখ্যা কম। আকারে ইরানের তুলনায় ০.৬ শতাংশ মাত্র। আর জনসংখ্যা তেহরানের জনসংখ্যার সমান। কাজেই তাদের পক্ষে যুদ্ধ অব্যাহত রাখা সম্ভব ছিল না। যুদ্ধ চলার সময় প্রতি ঘণ্টায় আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে উড়োজাহাজ ইসরাইলে নামছিল। এসব বিমান সমরাস্ত্রসহ আরো নানা কিছু ছিল। কারণ তেলআবিবের অস্ত্রভাণ্ডার প্রায় খতম হওয়ার পথে ছিল। বিমানবিধ্বংসী বা ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র তাদের ফুরিয়ে আসছিল। যুদ্ধ তারা শান্তি চায় বলে বন্ধ করেনি। তারা আর চালাতে পারছিল না। গাজায় যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। যেখানে সম্ভব তারা আগ্রাসন অব্যাহত রাখে। কিন্তু যখন ক্ষমতায় আর কুলায় না তখন আপস করে।

নয়া দিগন্ত : এ যুদ্ধ থেকে কী শিখল ইরান বা যুদ্ধের শিক্ষা কী ছিল?

সিরাজি : ইরানের নীতিমালার বড় জিনিসটি হলো, স্বনির্ভরতা। যুদ্ধের সময় একটা দেশও ইরানকে কিছুই সরবরাহ করেনি। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় এরকম তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছে। এ কারণে ইরান বেশির ভাগ সমরাস্ত্র নিজেরাই ইরানের ভেতরে তৈরি করে। ইরানকে তাই বাইরের কোনো দেশের ওপর নির্ভর করতে হয় না।

শৈশব এবং কৈশোর বাংলাদেশে কেটেছে এবং এ দেশের মানুষের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনা করে সাক্ষাৎকার শেষ করেন তিনি।