৫ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিলেও গাজায় ইসরাইলি হামলা অব্যাহত

Printed Edition

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

  • যুদ্ধবিরতিতে অটল থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হামাস
  • গাজায় শিশুদের জন্য নতুন আতঙ্ক খেলনাবোমা
  • গাজায় আবারো অভিযান শুরু করবে ইসরাইল

হামাসের সাথে নাজুক যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে পাঁচ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে ইসরাইল। সোমবার সন্ধ্যায় মুক্তি পাওয়া পাঁচজনকে চিকিৎসা পরীক্ষার জন্য দেইর আল-বালাহর আল-আকসা হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে গাজায় প্রাণঘাতী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। আলজাজিরা এ খবর জানিয়েছে।

বন্দী মুক্তির খবরে হাসপাতালের বাইরে স্বজনরা জড়ো হন। কেউ মুক্ত বন্দীদের জড়িয়ে ধরেন, আবার কেউ নিখোঁজ পরিবার সদস্যদের খোঁজে উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করেন। আলজাজিরার রিপোর্টার হিন্দ খুদারি বলেন, যুদ্ধবিরতির পর এই প্রথম ইসরাইল অজ্ঞাত পরিচয় ফিলিস্তিনি বন্দী মুক্তি দিলো। তবে এখনও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ইসরাইলি কারাগারে বন্দী আছেন। তাদের অনেকেই অভিযোগ ছাড়াই আটক আছেন। একে মানবাধিকার সংগঠনগুলো স্বেচ্ছাচারী আটক হিসেবে বর্ণনা করেছে। নিহত ফিলিস্তিনিদের লাশও ফেরত দিচ্ছে ইসরাইল। সোমবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির (আইসিআরসি) মাধ্যমে ইসরাইল থেকে আরো ৪৫টি লাশ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে যুদ্ধবিরতির আওতায় ফেরত পাওয়া লাশের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭০। ফরেনসিক দল এখন পর্যন্ত ৭৮টি লাশ শনাক্ত করেছে এবং বাকি লাশ শনাক্তের কাজ চলছে। শনাক্তের পর লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

এর আগে কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, ফেরত পাওয়া বহু লাশে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। এর মধ্যে হাত বাঁধা, চোখ বাঁধা, মুখমণ্ডলে বিকৃতি এবং অনেক লাশ পরিচয় ট্যাগ ছাড়াই ফেরত দেয়া হয়েছে। খুদারি জানান, যদি লাশগুলো শনাক্ত না হয়, সেগুলো দেইর আল-বালাহতে গণকবরে দাফন করা হবে। তুরস্ক, মিসর ও কাতারের মধ্যস্থতায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতায় যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের অংশ হিসেবেই বন্দী ও মরদেহ বিনিময় হচ্ছে। যুদ্ধবিরতি ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়।

এ দিকে যুদ্ধবিরতি চললেও ইসরাইল প্রাণঘাতী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। নাসের মেডিক্যাল কমপ্লেক্সের এক সূত্র আলজাজিরাকে জানায়, সোমবার রাফাহর উত্তরে ইসরাইলি হামলায় তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা দক্ষিণ গাজায় হামলা চালিয়েছে। কারণ ‘ইয়েলো লাইন’ অতিক্রম করে ব্যক্তিরা ইসরাইল-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রবেশ করেছিল। একে তারা যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছে। ইসরাইলের এই দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি। এ ছাড়া গাজা সিটিতে আল-আহলি আরব হাসপাতালের এক সূত্র জানায়, শহরের পূর্ব দিকে ইসরাইলি হামলায় একটি শিশুসহ তিনজন আহত হয়েছে। গাজা সিটি থেকে আলজাজিরার রিপোর্টার তারেক আবু আজযুম জানান, ইসরাইল আংশিক ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোতে কোয়াডকপ্টার ড্রোন থেকে গ্রেনেড ফেলছে। এখানকার কর্তৃপক্ষ এগুলোকে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন হিসেবে বর্ণনা করছে। গাজার সরকারি গণমাধ্যম অফিস বলেছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরাইল ১২৫টিরও বেশি লঙ্ঘন করেছে। এসব অব্যাহত থাকলে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ আবার শুরু হওয়ার ঝুঁকি আছে।

যুদ্ধবিরতিতে অটল থাকতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হামাস

ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী সংগঠন হামাস গাজা উপত্যকার যুদ্ধবিরতিতে অটল থাকার বিষয়ে ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’ বলে জানিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান। তিনি বলেন, মুসলিম দেশগুলোর উচিত ফিলিস্তিন পুনর্গঠনে নেতৃত্ব দেয়া। সোমবার ইস্তাম্বুলে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক বার্ষিক সম্মেলনের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে এরদোগান বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে, হামাস চুক্তি মেনে চলার ব্যাপারে যথেষ্ট দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’

তার এ মন্তব্য এমন সময় এলো, যখন তুরস্ক গাজা ইস্যুতে আলোচনার জন্য সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্দান, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আতিথ্য দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গতকাল মঙ্গলবার এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অক্টোবরের ১০ তারিখে ঘোষিত যুদ্ধবিরতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার মধ্যে এ বৈঠক হচ্ছে।

বৈঠকটি ইস্তাম্বুলের একটি হোটেলে বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টায় শুরু হয়। কয়েক ঘণ্টা পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের কথা রয়েছে। এরদোগান বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত গাজার মানুষের কাছে আরো বেশি মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়া। এর পর শুরু করতে হবে পুনর্গঠনের কাজ। ইসরাইলি সরকার তা ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে।’ তিনি বলেন, ‘আরব লিগ ও ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার যৌথভাবে প্রস্তুত করা পুনর্গঠন পরিকল্পনাটি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা উচিত।’ তিনি মার্চ মাসে ঘোষিত ফিলিস্তিন পুনর্গঠন পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করছিলেন। এরদোগান বলেন, ‘গাজা পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় ওআইসি ও কমসেকের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা নেয়া অত্যাবশ্যক।’

গাজায় শিশুদের জন্য নতুন আতঙ্ক খেলনাবোমা

গাজা উপত্যকার স্বাস্থ্যবিষয়ক মহাপরিচালক মুনির আল-বুরশ জানিয়েছেন, ইসরাইলি বাহিনী শিশুদের আকৃষ্ট করতে বিস্ফোরকযুক্ত পুতুল ও খেলনা রেখে যাচ্ছে। তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও এই ভয়াবহ কৌশলকে ইসরাইলের ‘চলমান গণহত্যার নতুন রূপ’ বলে অভিহিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে আল-বুরশ লিখেছেন, ‘পুতুলাকৃতির বোমা; ইসরাইলি সেনারা শুধু ধ্বংসস্তূপ রেখে যায়নি, শিশুদের হাতে রেখে গেছে টাইম বোমা।’

তিনি জানান, গাজার গলি ও ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপে অবিস্ফোরিত শেল ও রকেটের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যেন ইসরাইলি সেনারা চলে যাওয়ার পরও তাদের হত্যালীলা অব্যাহত থাকে। প্রতিদিন হাসপাতালে শিশুদের ছিন্নভিন্ন দেহ, বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও বিকৃত মুখমণ্ডল নিয়ে আসা হচ্ছে। তার মতে, শৈশবের কৌতূহল ও নিষ্পাপতার কারণেই তারা এই পরিণতির শিকার হচ্ছে।

আল-বুরশ আরো বলেন, ‘যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অবশিষ্টাংশ হলো সেইসব জিনিস যা শয়তানের মুখে ফেরেশতার চেহারা- বিস্ফোরকযুক্ত খেলনা। পুতুল, পাখি ও ছোট টেডি বিয়ার এমনভাবে ফেলে রাখা হয়েছে, যেন শিশুরা এগুলোর দিকে হাত বাড়ায়। আর যখনই তারা তা স্পর্শ করে, তখনই ভয়ঙ্কর সত্য বিস্ফোরিত হয়।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যে সেনাবাহিনী নিজেদের নৈতিকতার দাবিদার বলে, তারা শৈশবের হৃদয়ে মৃত্যুর ফাঁদ পেতেছে।’পোস্টের শেষে তিনি উল্লেখ করেন, ‘একটি পুতুল হয়ে গেছে একটি স্থলমাইন, ছোট টেডি বিয়ার রূপ নিয়েছে বিকলাঙ্গতার অস্ত্রে, আর রঙিন বল হয়ে উঠেছে এমন ফাঁদ, যা এক শিশুর পুরো শৈশব কেড়ে নিচ্ছে।’ গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে হাজার হাজার শিশু হতাহত হয়েছে এবং অবশিষ্ট বিস্ফোরকগুলো নতুন বিপদ তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ঘটনাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

গাজায় আবারো অভিযান শুরু করবে ইসরাইল

ইসরাইলের জ্বালানি ও অবকাঠামো বিষয়ক মন্ত্রী এলি কোহেন জানিয়েছেন, বন্দীদের বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে গাজায় আবারো তীব্র সামরিক অভিযান শুরু করবে ইসরাইল। মিডল ইস্ট আই সূত্রে জানা যায়, তিনি বলেন, হামাস কখনোই স্বেচ্ছায় অস্ত্র ত্যাগ করবে না এবং কোনো আন্তর্জাতিক বাহিনী তাদের নিরস্ত্রীকরণে সফল হবে না। চ্যানেল ৭-এ দেয়া সাক্ষাৎকারে কোহেন বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত। জীবিত বন্দীরা পরিবারের কাছে ফিরে আসার পর আমাদের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ আরো বিস্তৃত হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, সময় ইসরাইলের পক্ষেই কাজ করছে এবং হামাস এখন সময়ের ধার ধারছে না। কোহেন দাবি করেন, ইসরাইল ইতোমধ্যে লেবানন, সিরিয়া ও গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করেছে। বর্তমানে গাজার অর্ধেকের বেশি অঞ্চল, সীমান্ত ক্রসিং, ফিলাদেলফি করিডোর ও মানবিক সহায়তার রুট ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

ট্রাম্পের নেতৃত্বে ২ বছরের জন্য গাজার শাসনক্ষমতা চায় যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা

যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা অন্তত দুই বছরের জন্য গাজা শাসনের দায়িত্ব নিতে চায়। একই সাথে গাজায় কোনো শান্তিরক্ষী বাহিনী নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক বলপ্রয়োগকারী বাহিনী মোতায়েন করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। এই বিষয়ে দেশটি এরই মধ্যে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের কয়েকটি সদস্য দেশের কাছে একটি খসড়া প্রস্তাব পাঠিয়েছে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস মার্কিন প্রশাসনের এক ক্লাসিফায়েড বা গোপন নথির বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে। সংবাদ মাধ্যমটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র গতকাল সোমবার জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্রকে গাজায় অন্তত দুই বছরের জন্য একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী গঠনের খসড়া প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ওই খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে গাজা শাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ২০২৭ সালের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত ম্যান্ডেট দেয়া হবে। প্রয়োজনে এই সময়সীমা বাড়ানোও সম্ভব হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা অ্যাক্সিওসকে জানিয়েছেন, এই খসড়ার ভিত্তিতে আগামী কয়েক দিনে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আলোচনা চলবে। লক্ষ্য হলো আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভোটের মাধ্যমে প্রস্তাবটি গৃহীত করা এবং জানুয়ারির মধ্যে গাজায় প্রথম সেনা মোতায়েন করা।