তুরাবকে গুলির সময় হাত উঁচিয়ে বলেছিলাম ‘আমরা সাংবাদিক’

শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলি সহকর্মীর কোলে প্রাণ হারান সাংবাদিক আবু তুরাব

দৈনিক ‘৭১-এর কথা’ পত্রিকার ফটো সাংবাদিক মো: মোহিদ হোসেন ট্রাইব্যুনালে নয়া দিগন্তের সিলেট ব্যুরো প্রধান এটিএম তুরাব হত্যার সেই বিভীষিকাময় দিনের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এ কথা বলেন।

নিজস্ব প্রতিবেদক
Printed Edition

‘দস্তগীর ভাই, আমরা সাংবাদিক; আমাদের গুলি কইরেন না।’ দু’হাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মো: মোহিদ হোসেন তখন জানতেন না, তার আর্তি বাতাসে মিলিয়ে যাবে। চোখের সামনেই গুলিতে লুটিয়ে পড়েন তার সহকর্মী নয়া দিগন্তের সিলেট প্রতিনিধি আবু তুরাব। দৈনিক ‘৭১-এর কথা’ পত্রিকার ফটো সাংবাদিক মো: মোহিদ হোসেন সেই বিভীষিকাময় দিনের সাক্ষ্য দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালে।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দশম দিনে গতকাল সোমবার ৩০তম সাক্ষী হিসেবে তিনি এই জবানবন্দী দেন। তিনি ছাড়াও এদিন আরো পাঁচজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেল এই সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। ট্রাইব্যুনালের বাকি দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে তাদের জেরা করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম। সাথে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।

সাংবাদিক মো: মোহিদ হোসেন বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। ওই দিন বিএনপির দেশব্যাপী ঘোষিত গায়েবানা নামাজে জানাজার কর্মসূচি ছিল। তারই অংশ হিসেবে সিলেটের মধুবন পয়েন্টের নিকটে অবস্থিত কালেক্টরেট জামে মসজিদে জুমার নামাজের পর একটি গায়েবানা জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। আমি সংবাদ সংগ্রহের জন্য যাই। ১৯ জুলাইয়ের আগে আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের গায়েবানা জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয় এবং নামাজে জানাজা শেষে একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি জিন্দাবাজারের দিকে যাওয়ার সময় পুলিশ পেছন দিক থেকে অতর্কিতে গুলি বর্ষণ করে। আমি ও আমার সহকর্মী সাংবাদিক আবু তুরাব পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলাম। পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছিল। আমি হাত উঁচিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে বলছিলাম, দস্তগীর ভাই (এডিসি) আমরা সাংবাদিক, আমাদের গুলি কইরেন না। তারপরও পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকে।

তিনি বলেন, পুলিশের গুলিতে আমার সহকর্মী নয়া দিগন্ত পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আবু তুরাব গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে বসে পড়েন। তাকে আমি রিকশায় এবং পরে সিএনজিতে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন চিকিৎসায় বাধা দেয়ায় তাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ওই দিনই সন্ধ্যা ৬টা ৪৫ মিনিটে তিনি মারা যান। পুলিশের এডিসি সাদিক কাউসার দস্তগীর, কোতয়ালি থানার এসি মিজানুর রহমান, কোতয়ালি থানার ওসি মহিউদ্দিন আরো অনেকে গুলি বর্ষণ করে। ওই ঘটনার একটি ভিডিও সংগ্রহ করেছি। ওই ভিডিও সম্বলিত একটি পেনড্রাইভ অদ্য ট্রাইব্যুনালে দাখিল করলাম। ভিডিওটি অদ্য ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত হয়। ভিডিওটিতে বিক্ষোভ মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি বর্ষণের দৃশ্য এবং গুলিবিদ্ধ সাংবাদিক আবু তুরাবকে মাটিতে বসে থাকতে এবং পরে তাকে এই সাক্ষী কর্তৃক রিকশায় হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখা যায়। আমি তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে জবানবন্দী দেয়ার পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আলজাজিরা, বিবিসির ডকুমেন্টারির মাধ্যমে জানতে পারি যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। পরে আরো জানতে পারি এ ঘটনার জন্য আরো দায়ী তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের প্রধান, স্বরাষ্ট্রসচিবসহ আরো অনেকে।

সাংবাদিক মো: মোহিদ হোসেনের পর হুমায়ূন কবির লিটন নামে মামলার ৩১তম সাক্ষী হিসেবে আরো একজন সাংবাদিক সাক্ষী দিতে এসে বলেন, আমি আগের সাক্ষীর বক্তব্যই উপস্থাপন করতে চাই। তখন আদালত এটাকে পিডব্লিউ ডেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর ৩২তম সাক্ষ্য দেন ডা: মোহাম্মদ হাসানাৎ আল মতিন। তিনি বলেন, আমি মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছি। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শামসুল ইসলাম নামক একজন গুলিবিদ্ধ রোগীর অস্ত্রোপচার করে একটি বুলেট বের করা হয়েছিল। পরে সেই রোগী আইসিইউতে মারা যায়। চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তা তা জব্দ তালিকা মূলে জব্দ করে নিয়ে আসেন। জব্দ করার সময় আমাদের রেকর্ড কিপার ফাহাদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। এরপর আরো তিনজন সাক্ষ্য দেন। তারা হলেন, ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের ট্রমা ম্যানেজমেন্ট সেন্টারে কর্মরত ওয়ারেন্ট অফিসার তারেক নাসরুল্লাহ, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসনের (নিটোর) সহকারী পরিচালক ডা: মো: রশিদুল আলম ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টোর অফিসার ডা: রাহাদ বিন কাশেম। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার মামলার ৩৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার পরববর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।

এর আগে, ২৬ আগস্ট নবম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়। ওই দিন এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন পাঁচজন। তারা হলেন- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা: মফিজুর রহমান, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা: মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডা: মোস্তাক আহমেদ, ফেনীর ব্যবসায়ী আহত নাসির উদ্দিন ও শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের নানা মো: সাঈদুর রহমান। এখন পর্যন্ত মোট জবানবন্দী দিয়েছেন ২৯ জন সাক্ষী।

জবানবন্দী শেষে তাদের জেরা করেন শেখ হাসিনা ও কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো: আমির হোসেন। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এম এইচ তামিম। সাথে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, প্রসিকিউটর মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা।

গত ২৫ আগস্ট অষ্টম দিনেও পাঁচজনের জবানবন্দী রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল। তারা হলেন- জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা: খায়ের আহমেদ চৌধুরী, একই হাসপাতালের রেটিনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: জাকিয়া সুলতানা নীলা, শহীদ মারুফ হোসেনের বাবা মোহাম্মদ ইদ্রিস, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার ও শহীদ আব্দুর রাজ্জাক রুবেলের মা হোসনে আরা বেগম।

২৪ আগস্ট সপ্তম দিনে সাক্ষ্য দেন রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অফিস সহকারী মো: গিয়াস উদ্দিন, একই প্রতিষ্ঠানের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: রাজিবুল ইসলাম ও কুষ্টিয়ার স্থানীয় সাংবাদিক শরিফুল ইসলাম। ২০ আগস্ট ষষ্ঠ দিনে জবানবন্দী দেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, একই হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহনাজ পারভীন, ইবনে সিনা হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা: হাসানুল বান্না এবং শহীদ শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল।

১৮ আগস্ট পঞ্চম দিনের সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন শহীদ আস-সাবুরের বাবা মো: এনাব নাজেজ জাকি, শহীদ ইমাম হাসান তাইমের ভাই রবিউল আউয়াল ও রাজশাহীর প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন। ১৭ আগস্ট চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল। তারা হলেন সবজি বিক্রেতা আবদুস সামাদ, মিজান মিয়া, শিক্ষার্থী নাঈম শিকদার ও শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহীনা বেগম।

৬ আগস্ট প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে জবানবন্দী দেন রিনা মুর্মু ও সাংবাদিক এ কে এম মঈনুল হক। ৪ আগস্ট পঙ্গু হওয়া শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল ইমরান ও দিনমজুর চোখ হারানো পারভীনও সাক্ষ্য দিয়েছেন। ৩ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার সূচনা বক্তব্যের পর প্রথম সাক্ষী হিসেবে নিজের সাথে ঘটে যাওয়া বীভৎস বর্ণনা তুলে ধরেন আন্দোলনে আহত খোকন চন্দ্র বর্মণ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও আসামি হিসেবে রয়েছেন। তবে নিজের দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছেন তিনি। কাঠগড়ায় তার উপস্থিতিতেই জবানবন্দী দিচ্ছেন সাক্ষীরা।

এর আগে, ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনে প্রসিকিউশন।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্য সূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার রয়েছে। সাক্ষী হিসেবে রয়েছেন ৮১ জন। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এই অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা।