ভারত কি বাণিজ্যযুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে?

ডিপ্লোম্যাটের বিশ্লেষণ

ধারণা করা হচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে বাণিজ্যিকভাবে মোকাবেলার পাশাপাশি বৈচিত্র্য ধরে রাখার নয়াদিল্লির প্রচেষ্টা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জুয়া।

নয়া দিগন্ত ডেস্ক
Printed Edition

ট্রাম্পের শুল্কারোপে ভারত এক অনিশ্চিত অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে তিনটি কৌশল একসাথে ব্যবহার করছে। প্রথমত ওয়াশিংটনের সাথে নতুন কোনো চুক্তি করতে পারছে না নয়াদিল্লি। এক্ষেত্রে মোদির অভ্যন্তরীণ সমর্থন যাতে বিপন্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত চীনের সাথে ভারত তার ভূ-অর্থনৈতিক সম্পর্ককে সূক্ষ্মভাবে পরিচালনা করে পূর্ববর্তী সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা উদ্বেগ উপেক্ষা না করে বেইজিংয়ের সাথে উত্তেজনা কমিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। তৃতীয়ত নিজেদের অর্থনীতিকে বিকল্প অংশীদারদের কাছে বৈচিত্র্যময় করে ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাকাক্সক্ষাকে এগিয়ে নিতে চাইছে। দ্য ডিপ্লোম্যাট এ অভিমত দিয়ে বলছে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রফতানি তার জিডিপির ২ শতাংশ ছিল। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা গোল্ডম্যান শ্যাক্স শঙ্কা প্রকাশ করে বলছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ধাপে ২৫ শতাংশ শুল্ক ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ০.৩ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে দেবে, অতিরিক্ত সেকেন্ডারি শুল্ক কার্যকর হলে তা দ্বিগুণ হারে হ্রাস পাবে। ধারণা করা হচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে বাণিজ্যিকভাবে মোকাবেলার পাশাপাশি বৈচিত্র্য ধরে রাখার নয়াদিল্লির প্রচেষ্টা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জুয়া।

ট্রাম্পের শুল্ক চাপ পরিচালনা

শুল্ক হুমকির সম্মুখীন হয়ে নয়াদিল্লি তার মূল স্বার্থের সাথে আপস না করে ওয়াশিংটনের সাথে ৫৫ শতাংশ মার্কিন রফতানির ওপর শুল্ক হ্রাস এবং আমেরিকান প্রতিরক্ষা ও জ্বালানি পণ্য কেনা বাড়াতে হচ্ছে। ভারতীয় কর্মকর্তারা চাচ্ছেন পনির এবং বাদামের মতো সীমিত পরিসরে কৃষিপণ্যের ওপর শুল্ক কমাতে, যা দেশীয় উৎপাদকদের ওপর ন্যূনতম প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে ভারতীয় কৃষকদের সাথে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অবস্থানকে দুর্বল করলে তা রাজনৈতিক আত্মহত্যা হবে। চুক্তি করলেও ট্রাম্প তা থেকে যে পিছু হটবেন এমন কোনো গ্যারান্টি খুঁজে পাচ্ছে না ভারত। ট্রাম্প আপাতদৃষ্টিতে ধৈর্য হারাচ্ছেন এবং একবার চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য ইতোমধ্যেই ভারতের ওপর শুল্কারোপ করেছেন। আলোচনা স্থগিত থাকলেও, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অর্থনীতিগুলো কম শুল্ক হার অর্জন করেছে যা তাদের ভারতের তুলনায় মার্কিন বাজারে আরো প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে।

ভারত কি চীনের ওপর নির্ভর করতে পারে?

ওয়াশিংটনের শুল্ক হুমকির মধ্যে চীনের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি ভারতের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করতে পারে, যদি তারা চীনে কাঁচামাল রফতানি বাড়াতে পারে। বেইজিং ইউরিয়ার ওপর রফতানি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করেছে, যার মধ্যে ভারত বিশ্বের বৃহত্তম আমদানিকারক। গত বছর, চীনের সাথে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯৯.২১ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন আমদানি, যেমন ইলেকট্রনিক্স, টেক্সটাইল এবং উৎপাদন। চীনের সাথে অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সহযোগিতায় ভারতীয় বাজার চীনা পণ্যে সয়লাব হতে পারে। চীন উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলায় বৃহত্তর ভূমিকা পালন করায় ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন বেইজিংয়ের কাছে অত্যন্ত কৌশলগত এবং প্রায়শই যা নিজস্ব স্বার্থে নেয়া হয়। তাই ভারতকে বিষয়টি সাবধানতার সাথে বিবেচনা করতে হবে। চীনকে ছাড় দিলে বেইজিং ভারতের বিতর্কিত সীমান্তে আক্রমণাত্মক অবস্থান বজায় রাখলে মোদিকে দুর্বল দেখাবে এবং বিরোধীদের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে।

বৈচিত্র্যকরণ প্রচেষ্টা

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ভারত কি বিকল্প অংশীদারদের সাথে অর্থপূর্ণ বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হবে? ভারতীয় প্রচেষ্টায় দেশীয় শিল্পকে রক্ষার উদ্বেগ এবং ডাটা নিয়ন্ত্রণের মতো বিতর্কিত বিষয়গুলো বেশ কয়েকটি অংশীদারের সাথে আলোচনা স্থগিত করে। ভারত সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত করেছে। চিলি এবং অস্ট্রেলিয়ার সাথে চুক্তিগুলোকে আরো শক্তিশালী করার পাশাপাশি ইইউ, নিউজিল্যান্ড, পেরু এবং ওমানের সাথে বাণিজ্য আলোচনা ত্বরান্বিত করেছে। ভারত ব্রিকস ব্লকের অন্যান্য সদস্যদের সাথেও সম্পর্ক জোরদার করছে। তবে ভারতের প্রায় ১৮ শতাংশ রফতানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায় এবং ভারতের প্রায় ১৫ শতাংশ আমদানি চীন থেকে আসে, এ ধরনের প্রচেষ্টা দু’টি বৃহৎ শক্তির ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে না।

ভারতের ওষুধ শিল্প চীনের বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে এবং সেমিকন্ডাক্টর, যেখানে সরকার উচ্চাকাক্সক্ষী দেশীয় উদ্যোগ শুরুর পর দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং তাইওয়ানের সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে। ভারতে টেকসই বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়নে অনিচ্ছুক বা অক্ষম।

ভারতীয় রফতানি চীন এবং উদীয়মান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির কাছ থেকে কঠোর প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছে। চীনের উৎপাদন স্কেলের সাথে ভারত তাল মেলাতে হিমশিম খাবে এবং ভারতীয় রফতানি উন্নত বাজারগুলোতে প্রতিযোগিতা করতে হিমশিম খেতে পারে- যেমন ইইউ এবং কানাডা। যাদের ইতোমধ্যেই ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় প্রতিযোগীদের সাথে এফটিএ রয়েছে। ভারতে উৎপাদনকার্যক্রম সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে অ্যাপলের সিইও টিম কুককে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক সতর্কবার্তা থেকে বোঝা যায় যে তিনি মার্কিন সংস্থাগুলোর ভারতে উৎপাদন স্থানান্তরে আপাতত সাড়া দেবেন না।