জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে পদায়ন নিয়ে লেজেগোবরে পাকিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি ২৯ জেলায় যে ডিসি দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে বেশির ভাগ আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। পদায়নের পর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক জেলা প্রশাসকের পদায়ন বাতিল করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়নের জন্য নতুন করে ফিটলিস্টের সাক্ষাৎকার আহ্বান করা হয়েছে। বিকেলে নোটিশ করে সন্ধ্যায় সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। এই সাক্ষাৎকারে গত বছরের আগস্টে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে পরে নানা অভিযোগে যোগদানের আগেই বাতিল হওয়া একজন কর্মকর্তাকেও ডাকা হয়েছে। প্রশাসনে এসব ঘটনা নজীরবিহীন বলে জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
জনপ্রশাসন সূত্র জানায়, নির্বাচনকে সামনে রেখে গত শনি ও রোববার দুই দিনে দেশের ২৯ জেলায় নতুন প্রশাসক (ডিসি) পদায়ন করে সরকার। এর মধ্যে রোববার ১৪ জেলায় এবং আগের দিন ১৫ জেলায় নতুন ডিসি পদায়ন করা হয়। এই ২৯ জনের মধ্যে প্রথমবার ডিসি করা হয় ২১ কর্মকর্তাকে। বাকি আটজন ডিসিই ছিলেন, তাদের জেলা পরিবর্তন করা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দু’টি প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিসিএস ২৫তম ও ২৭তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের দু’জন কর্মকর্তাকে ডিসি করা হয়েছে, যাদের একজন ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে, অন্য জন ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন।
২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে এআরও ছিলেন মেহেরপুরের ডিসি হিসেবে পদায়ন পাওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব। এই কর্মকর্তা দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত থেকে শেখ হাসিনার পতনের পর উপসচিব পদোন্নতি পেয়েছিলেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনের এআরও বিসিএস ২৫তম ব্যাচের একজন কর্মকর্তাকে বরগুনার ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৮ সালে উপসচিব পদে পদোন্নতি পান। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের সময় তিনি আশুগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সহকারী রিটার্নিং অফিসার (এআরও) ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
এই দুই কর্মকর্তাসহ সদ্য পদায়ন হওয়া একাধিক কর্মকর্তার পদায়ন বাতিলের চিন্তা করছে সরকার। যদিও বর্তমানে মাঠ প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করা জেলা প্রশাসকদের মধ্যে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৫ ব্যাচের ২৭ জন ডিসির মধ্যে ১৮ জন ২০১৪ সালের নির্বাচনে এরআরও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া ২৭ ব্যাচের একজন কর্মকর্তা ২০১৮ সালের নির্বাচনে এআরও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কোনো কর্মকর্তাকে আসন্ন নির্বাচনে রাখা হবে না- এমন সিদ্ধান্ত নিলেও সেটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে সরকার।
ভোটের মাঠে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনের ফিটলিস্ট করতে গতকাল বুধবার বিকেলে ১৫ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার আহ্বান করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিকেলে সাক্ষাৎকার আহ্বান করে সন্ধ্যায় সাক্ষাৎকার গ্রহণ জনপ্রশাসনে নজিরবিহীন ঘটনা। সরকারি কর্মকর্তাদের এমন সাক্ষাৎকারের জন্য কমপক্ষে দুই দিন আগে নোটিশ করার রেওয়াজ চালু রয়েছে। এ ছাড়াও জেলা প্রশাসক পদায়নের সাক্ষাৎকার গ্রহণের আগে সেই কর্মকর্তার প্রয়োজনীয় নম্বর, চাকরিজীবনের শৃঙ্খলা, দুর্নীতির বিষয়সহ সামগ্রিক বিষয়ের হালনাগাদ প্রতিবেদন সংগ্রহ করা হয়নি।
সাক্ষাৎকারের তালিকায় ১৪ নম্বরে রয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। তাকে গত বছরের আগস্টে দিনাজপুরে জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছিল। এরপর তার বিরুদ্ধে আওয়ামী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকায় যোগদানের আগেই পদায়ন বাতিল করা হয়।
নির্বাচনে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন এমন অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে আওয়ামী ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন হওয়া কর্মকর্তা ছিলেন প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের চেয়ারম্যানের সহকারী একান্ত সচিব। মাত্র ছয় মাস মাঠ প্রশাসনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে চলে আসেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উপপরিচালক হিসেবে।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন হওয়া নারী কর্মকর্তা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন সাবেক পানিসম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সাথে বিশেষ সখ্যতা থাকায় একই মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন পাঁচ বছর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দেয়া ভোলার জেলা প্রশাসককে গাজীপুরে বদলি করেছে সরকার। উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েই বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফুল দিয়ে শপথ নেয়া নড়াইলের ডিসিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বদলি করা হয়েছে। খাগড়াছড়ির স্থানীয় সরকারের উপপরিচালককে (ডিডিএলজি) মানিকগঞ্জের ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ম্যুরালে একাধিক ছবি তুলেছেন। হাতে আসা তথ্যপ্রমাণে খাগড়াছড়ির ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথেও তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে। তিনি বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তাকে ময়মনসিংহের ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তিনিও বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাদের দু’জনেরই মাঠ প্রশাসনে উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
বাগেরহাটের ডিসিকে নোয়াখালীতে পদায়ন করা হয়েছে। এই কর্মকর্তা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের অন্যতম সুবিধাভোগী। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। মাঠ প্রশাসনে কাজের পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি দুই জেলার ডিসির দায়িত্ব পান।



