শীর্ষ নেতাদের খালেদা জিয়া

ড. ইউনূসের সাথে বিরোধ নয়, আলোচনা করুন

মঈন উদ্দিন খান
Printed Edition
বেগম খালেদা জিয়াকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতারা: নয়া দিগন্ত
বেগম খালেদা জিয়াকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপি নেতারা: নয়া দিগন্ত
  • তারেক রহমানের সাথে বৈঠক শুক্রবার
  • বৈঠক হতে পারে টার্নিং পয়েন্ট: ফখরুল

নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূসের সাথে প্রত্যক্ষ বিরোধে না জড়িয়ে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি এও বলেছেন, ‘যদি ড. ইউনূস না থাকেন, তাহলে কী হবে, সেটাও তো ভাবতে হবে।’

ঈদুল আজহার দিন রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়াকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে তিনি এই নির্দেশনা দেন।

জানা গেছে, বেগম জিয়ার এই নির্দেশনার পরই এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণায় ক্ষুব্ধ বিএনপির শীর্ষ নেতারা হার্ডলাইনের বদলে সমঝোতা ও আলোচনার পথে হাঁটা শুরু করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আগামী ১৩ জুন লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে হোটেল ডোরচেস্টারে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন সফরে যাবেন, এমন খবরে গত কয়েক দিন ধরে এই বৈঠকের সম্ভাবনার কথা শোনা যাচ্ছিল। গত সোমবার বৈঠকটি চূড়ান্ত হয়। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বৈঠকটিকে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিএনপির পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে দেশের অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে।

ঈদের আগের দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের যেকোনো দিন অনুষ্ঠিত হবে। এর ভিত্তিতে ওই দিন রাতেই স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠকে বসেছিল বিএনপি। সেই বৈঠকে নির্বাচনের নতুন রোডম্যাপ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির অবস্থান কী হবে তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতামত আসে। কমপক্ষে চারজন নেতা কট্টর কোনো অবস্থান না নিয়ে বিএনপি কী চায়, নমনীয়ভাবে সেটি তুলে ধরার পক্ষে মত দেন। তাদের কেউ কেউ নতুন রোডম্যাপের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করলেও ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থাৎ রোজার আগেই নির্বাচন হওয়া উচিত বলে অভিমত দেন। তবে বাকি প্রায় আটজন নেতা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবিতে দলের আগের অবস্থানের পক্ষে অনড় থাকার কথা বলেন। পরে স্থায়ী কমিটির বিবৃতিতে সেটাই উঠে এসেছে, যেখানে রোডম্যাপের বিষয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। বিবৃতির মধ্যে একপর্যায়ে বলা হয়, ভাষণে ড. ইউনূস শব্দ চয়নে রাজনৈতিক ভব্যতার সীমা অতিক্রম করায় সভায় ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। অবশ্য নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এমন কড়া বিবৃতিকে দলটির কোনো কোনো নেতা ভালোভাবে নেননি।

খালেদা জিয়ার নির্দেশনা : রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপির অবস্থান জানানোর পরদিন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা খালেদা জিয়ার সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সেখানে একপর্যায়ে নির্বাচনের নতুন রোডম্যাপের বিষয়টি উঠে আসে। নতুন রোডম্যাপ অনুযায়ী আবহাওয়ার সঙ্কট, রমজানসহ নানান কারণে এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের সাথে সরাসরি কোনো ধরনের বিরোধে না জড়ানোর নির্দেশ দেন বেগম জিয়া। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, সরকারের সাথে সঙ্ঘাতে গেলে বিএনপির কোনো লাভ নেই। তাই বিরোধ নয়, সঙ্কট সমাধানে আলোচনাই শ্রেয়। সে পথেই হাঁটতে হবে। যদি ড. ইউনূস না থাকেন, তাহলে কী হবে, সেটাও তো ভাবতে হবে। তাই যুক্তির আলোকে কিভাবে নির্বাচনের রোডম্যাপ এগিয়ে নিয়ে আসা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

ড. ইউনূসকে বিএনপির অবস্থান জানাবেন তারেক রহমান : জানা গেছে, গত সোমবার রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে লন্ডনে ড. ইউনূসের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কী কী আলোচনা করবেন, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সেই দায়িত্ব পুরোপুরি তারেক রহমানের ওপর অর্পণ করা হয়। দেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি কী চায় এবং কেন চায়, ড. ইউনূসকে সেটি লিখিতভাবে তুলে ধরতে পারেন তারেক রহমান।

জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে বৈঠকে তিনটি ইস্যু প্রাধান্য পেতে পারে। নির্বাচন, সংস্কার ও বিচার। ডিসেম্বরে না হলে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থাৎ রোজার আগে যাতে নির্বাচনটা হয়ে যায়, সে বিষয়টিতে তারেক রহমান জোর দিতে পারেন বৈঠকে।

বিএনপির দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা বলেন, সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি এই সরকারকে শুরু থেকেই সর্বোতভাবে সহযোগিতা করছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে তারা সরকারের সাথে আলোচনায় অংশ নিচ্ছে। এমন অবস্থায় যেসব সংস্কারে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ঐকমত্য হয়েছে, ড. ইউনূসকে সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে বলবেন তারেক রহমান। বিএনপির অবস্থান হচ্ছে, ঐকমত্য হলেও যেসব সংস্কারে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন, সেটা নির্বাচিত সংসদ করবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতৈক্য সৃষ্টিতে উদ্যোগ নিতে সরকারপ্রধানকে আহ্বান জানাবেন তিনি। আর যেসব সংস্কারে ঐকমত্য হয়নি, সেগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ করবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেন, বিএনপি যে আওয়ামী লীগের গণহত্যার বিচার চায় এবং এটি নিয়ে যে তাদের কোনো ধরনের আপস নেই, সেটিও তারেক রহমান স্পষ্ট করে তুলে ধরবেন। বিএনপি মনে করে, বিচার একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই বিচারকে বিচারের প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক গতিতে চলতে দিতে হবে, যাতে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হয়। তবে বিচার প্রক্রিয়া যেন দ্রুততম সময়ে দৃশ্যমান হয় এবং সে ব্যাপারে ড. ইউনূস যাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সে বিষয়টিও তুলে ধরবেন।

তারা আরো বলেন, গত ১৫-১৬ বছরে বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক যে সংগ্রাম, সেখানে বিএনপির যে অবদান বিশেষ করে দলটির অসংখ্য নেতাকর্মী যে হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুনের শিকার, সেগুলো তারেক রহমান তুলে ধরবেন। এ ছাড়া নির্বাচন নিয়ে দেশী-বিদেশী যে নানা ষড়যন্ত্র, সেটিও তুলে ধরার পাশাপাশি বিএনপি যে ড. ইউনূসের অধীনেই নির্বাচন চায় এবং তার হাত ধরেই যে দেশের গণতন্ত্রে উত্তোরণ ঘটুকÑ এ বিষয়টিও প্রধান উপদেষ্টাকে বলবেন। তিনি এ-ও বলবেন যে, নির্বাচনের জন্য সর্বোত্তম সময় হচ্ছে আগামী ডিসেম্বর। তবে ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থাৎ রোজার আগে নির্বাচন হলে সব ষড়যন্ত্র কাটিয়ে উঠে গণতন্ত্রের রাস্তায় পথচলা শুরু হতে পারে।

বিএনপির ওই নেতাদের মতে, তারেক রহমান বৈঠকে ড. ইউনূসের কার্যক্রমের প্রশংসার পাশাপাশি ড. ইউনূস যে একটা ক্রিটিক্যাল সময়ে সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন, সেটাও তাকে বলবেন।

বৈঠকটি হতে পারে টার্নিং পয়েন্ট : ড. ইউনূসের সাথে লন্ডনে অনুষ্ঠিতব্য তারেক রহমানের বৈঠকটিকে এ সময়ের বড় ‘পলিটিক্যাল ইভেন্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল সকালে গুলশানে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, অনেক সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে এ বৈঠকে। অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে এবং অনেক কিছু সহজ হয়ে যেতে পারে। নতুন ডাইমেনশন সৃষ্টি হতে পারে এ বৈঠকে। নতুন এক দিগন্তের উন্মোচন হতে পারে।

মির্জা ফখরুল বলেন, এই মিটিংয়ের জন্য আমাদের স্ট্যান্ডিং কমিটির পক্ষ থেকে স্বাগত জানানো হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করছি, এটা বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সঙ্কট কাটাতে পজেটিভ ভূমিকা রাখতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে, সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যে অবস্থান সে ক্ষেত্রে এটা (বৈঠকটি) একটা বড় ইভেন্ট। যদি সব সঠিকভাবে চলে তাহলে নিঃসন্দেহে এটা এক বড় টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে।

তিনি বলেন, আমার মনে হয়, এই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ইম্পরটেন্ট ইভেন্ট। এই মিটিংয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। আমি মনে করি যে, জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবেও এটার গুরুত্ব অনেক বেশি। এ বৈঠকে নতুন ডাইমেনশন সৃষ্টি হতে পারে, সম্ভাবনা অনেক। এখন এটা নির্ভর করবে আমাদের নেতৃবৃন্দের (মুহাম্মদ ইউনূস-তারেক রহমান) ওপরে, তারা কিভাবে সেই সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাবেন। আমরা আমাদের দলের তরফ থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে সম্পূর্ণ অথোরিটি দিয়েছি, তার সাফল্য প্রার্থনা করেছি।

তারেক রহমান ফিরবেন শিগগিরই : মির্জা ফখরুল কাছে এ সময় প্রশ্ন ছিল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কবে দেশে ফিরবেন? বিএনপি মহাসচিব বলেন, তারেক রহমান নিশ্চয় দেশে ফিরবেন, অবশ্যই দেশে ফিরবেন। শিগগিরই ফিরবেন।

এখনো নির্ভুল পথের দিশারী খালেদা জিয়া : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ‘নির্ভুল পথের দিশারী’ বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারুফ কামাল খান। তিনি খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সেক্রেটারি। মঙ্গলবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে তিনি এ কথা বলেন।

মারুফ কামাল খান বলেন, ‘জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনের সর্বশেষ অগ্রগতি দেখে আমার মনে হচ্ছে, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে। আমি আশাবাদী হচ্ছি। আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি, দূর হোক রাজনীতির ভ্রান্তিবিলাস। পরাজিত হোক চক্রান্তের কূটাভাস।’

তিনি বলেন, ‘টোকাইতন্ত্রের ফাঁপরবাজি এড়িয়ে পরিণত নেতৃত্ব এগিয়ে যাক সঠিক পথ ধরে মঞ্জিলে মাকসুদের দিকে। দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনিবার্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। সমঝোতাই সাফল্যের সিঁড়ি। আবেগে নয়, বাস্তবতার আলোকে পথ ও শত্রু-মিত্র চিনে নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করুন তারেক রহমান। আর এখনো নির্ভুল পথের দিশারী হয়ে থাকায় বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা।’