সন্ধ্যা হলেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ফুটওভার ব্রিজ

রাজধানীর অধিকাংশ ব্রিজে নেই লাইটিং

দিনের আলো শেষ হতেই ব্রিজগুলো ভাসমান জনগোষ্ঠী, ভবঘুরে, ছিনতাইকারী ও মাদকাসক্তদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়।

আব্দুল কাইয়ুম
Printed Edition
ভবঘুরেদের দখলে রাজধানীর একটি ফুটওভারব্রিজ
ভবঘুরেদের দখলে রাজধানীর একটি ফুটওভারব্রিজ |সংগৃহীত

সন্ধ্যা হলেই রাজধানীর ফুটওভার ব্রিজগুলো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। দিনের আলো শেষ হতেই ব্রিজগুলো ভাসমান জনগোষ্ঠী, ভবঘুরে, ছিনতাইকারী ও মাদকাসক্তদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। ফলে নিরাপত্তাহীনতার কারণে পথচারীরা এগুলো এড়িয়ে চলেন। বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হন তারা। এদিকে অনেক অর্থ ব্যয় করে এসব ব্রিজ তৈরি হলেও পরিকল্পনা ও ডিজাইনে ভুল ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তা ছাড়া ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে এসব জায়গায়। বিশেষ করে নারীরা সন্ধ্যা হলেই ব্রিজ ব্যবহার করেন না। পথচারীদের অভিযোগ, সন্ধ্যার পর ব্রিজে অন্ধকার ও কিশোর গ্যাংয়ের আড্ডা থাকায় ঝুঁকি নিয়ে হলেও সড়ক দিয়ে পার হন তারা।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, ফুটওভার ব্রিজের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ভাইয়ের নামে ভিজিটিং কার্ড, সেইসাথে পড়ে রয়েছে বেশ কিছু আপত্তিকর প্যাকেট। তাছাড়া মাদক সেবনের বিভিন্ন জিনিস পড়ে আছে ব্রিজে বিভিন্ন ভাসমান লোকজন সেখানে শুয়ে-বসে আছেন। অন্য দিকে হকার তো আছেই। তবে রাত হলেই বাড়তে থাকে ব্রিজগুলোতে অন্ধকার। কিছু লোকজন বসে থাকে ব্রিজের দুই পাশের সিঁড়িতে। বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ পলিথিনের ভেতর গাম দিয়ে ড্যান্ডি নেশা করার চিত্রও চোখে পড়ে। এতে করে একদিকে অন্ধকার, অন্যদিকে মাদকাসক্তদের ভয়ের কারণে সন্ধ্যা হলেই ফুটওভার ব্রিজ এড়িয়ে চলতে দেখা যায় নগরবাসীকে। কিছু কিছু ফুটওভার ব্রিজে রাতে অসামাজিক কার্যক্রম চলতে দেখা যায়।

রাজধানীর কলাবাগান এলাকার বাসিন্দা আলী দোহা বলেন, আমাকে প্রতিদিনই রাস্তা পার হতে হয়। দিনের বেলা অনেক সময় ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করলেও রাতে করি না। কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, সন্ধ্যা হতেই ব্রিজ অন্ধকার হয়ে যায়। এতে করে সেখান দিয়ে যাওয়া নিরাপদ না। তা ছাড়া প্রায়ই চুরি, ডাকাতি ছিনতাই হচ্ছে। ফুটওভার ব্রিজগুলো হলো অসামাজিক কাজের আড্ডাখানা। সুযোগ পেলেই কাউকে আক্রমণ করে বসে। মাদক সেবনকারীরা এখানে নেশা করে এবং সেই সাথে ভাসমান পতিতারা দাঁড়িয়ে থাকে।

সাব্বিরুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি আমি টিউশনি করি। পড়ানো শেষ হতে আমার রাত হয়ে যায়। প্রথম প্রথম ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে রাস্তা পারাপার করলেও এখন যাই না। প্রায়ই দেখি মাদকাসক্ত ও ছিনতাইকারীরা বসে থাকে। আমার সামনের এক ব্যক্তিকে ছুরি দেখিয়ে তার কাছ থেকে সব কিছু নিয়ে যেতে দেখেছি। তারপর থেকে আর কখনো ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করা হয় না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী জানান, রাজধানীর কলাবাগান ফুটওভার ব্রিজে প্রকাশ্যে ড্যান্ডি সেবন করছেন এক ভবঘুরে। ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মাদকসেবনকারী ওই ভবঘুরে ব্যক্তি তার গায়ে হাত দেন। পরে ভয়ে মুহূর্তেই চিৎকার দিয়ে ওঠেন তিনি। পেছনে কয়েকজন পথচারী থাকায় কিছুটা ভরসা পান এই নারী।

পথচারীদের অভিযোগ, নিরাপত্তাহীনতার কারণে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে অনাগ্রহ তাদের। অধিকাংশ সময় এসব জায়গা বিভিন্ন বয়সী নেশাগ্রস্ত ও ভবঘুরেদের দখলে থাকে। এসব কারণে নারীরা পার হতে চায় না বলে জানান তারা। ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে হাঁটতেই খুব ভয় লাগে। সবসময় ভবঘুরেরা এখানে থাকে বিশেষ করে নারীরা সন্ধ্যার পরে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে চলাচল করে না। ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়িগুলোর অতিরিক্ত উচ্চতা এবং চলন্ত সিঁড়ি না থাকায় ব্যবহারে উৎসাহ নেই মানুষের। ব্রিজ ব্যবহারের চেয়ে হেঁটে সড়ক পারাপারে সময় কম লাগে। প্রতিটি ফুটওভার ব্রিজের সিঁড়ি অতিরিক্ত খাড়া এতে উঠতে গিয়ে বয়স্ক ও অসুস্থরা অল্পতে হাঁপিয়ে ওঠেন। রাতে এখানে মাদকসেবনকারী, ছিনতাইকারী এবং পতিতাদের উপস্থিতি বেশি থাকে। অনেক সময় ছিনতাইকারীরা সুযোগ বুঝে পথচারীদের মূল্যবান জিনিসপত্র কেড়ে নেয়।

এই বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ফুটওভার ব্রিজে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমাতে প্রতিনিয়ত আমাদের অভিযান পরিচালনা হচ্ছে। অনেক সময় সেখানে ছিনতাই ও চুরির মতো ঘটনা ঘটে। ফলে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাই কোনো ভবঘুরে ও অপরাধী সেখানে যেন অবস্থান করতে না পরে সেজন্য আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজধানীর আন্ডারপাস ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রে এখন থেকেই সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া দরকার। তা না হলে হুট করে যেমন নির্মাণের প্রবণতা থাকবে তেমনি আবার ভেঙে ফেলারও দরকার হবে। মেট্রোরেলে নির্মাণের কারণে হুমকিতে পড়তে পারে ঢাকার বেশ কিছু ফুটওভার ব্রিজ ও ফুটপাথ। তা ছাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে অনেকটা দূরে হওয়ার কারণে তারা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে অনেক সময় হেঁটেই রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করেন। আলো না থাকায় অনেক সময় ওভারব্রিজে ‘উল্টাপাল্টা লোকজন’ থাকে বলে নারী ও শিশুরা নিরাপদ বোধ করে না।

ঢাকার ফুটওভার ব্রিজগুলো ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারেনি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, ঢাকা শহরের পথচারীদের কথা চিন্তা করেই ফুটওভার ব্রিজের যাত্রা শুরু হয়। তবে এসব ফুটওভার ব্রিজ সাধারণ মানুষের ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠেনি। তৈরি হলেও রক্ষণাবেক্ষণ নাই বললেই চলে। এতে করে দিনে ও বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকেই ভাসমান জনগোষ্ঠী, ভবঘুরে, ছিনতাইকারী ও মাদকাসক্তদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। এতে করে প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে গত ছয় থেকে সাত বছর ধরে বেশি দেখে যাচ্ছে এসব স্থানে ভাসমান জনগণের বসবাস। ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ ক্ষেত্রে পথচারীদের ব্যবহার উপযোগিতার চেয়ে দেখানোর মানসিকতা বেশি কাজ করেছে। কেন দিন দিন এসব জায়গাগুলো অপরাধীদের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে, এসব নিয়ে কখনো অনুসন্ধান ও সমাধান করা হয়নি। অথচ প্রতি বছরই এর জন্য বাজেট হয় এবং ব্যয়ও দেখানো হয়। প্রশ্ন হলো, তারা এত টাকা কোথায় খরচ করছে? সরকারকে নিরাপদে রাস্তা পারাপারের জন্য সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টিকে মাথায় রাখতে হবে। তাহলে পথচারীদের ফুটওভার ব্রিজের প্রতি আগ্রহ বাড়বে। নয়তো ঝুঁকি নিয়েই মানুষ রাস্তা পারাপার হতে থাকবে।

ফুটওভার ব্রিজগুলো তৈরিতে ডিজাইনে ভুল ছিল উল্লেখ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান নয়া দিগন্তকে বলেন, ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের সময় সব বিষয় লক্ষ রেখেই করা দরকার ছিল। তাদের ডিজাইনটি মানুষের চলাচলে অনুপযোগী করে ডিজাইন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মানুষের চলাফেরায় যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার ছিল। পর্যাপ্ত লাইটিং থাকলে ছিনতাই, চুরি ও ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটতো না এবং পথচারীরা নিরাপদে পারাপার হতে পারতেন। ব্রিজগুলো ডিজাইনের সময় সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করা হয়নি। সিটি করপোরেশন বা কর্তৃপক্ষ কখনোই এগুলোকে তদারকি করেনি। কোনো ধরনের সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়াই তৈরি হয়েছে বলে অধিকাংশ ফুটওভার ব্রিজই শতভাগ কাজে লাগানো কঠিন। আবার উচ্চতার কারণেও অনেকে উঠতে চান না-যেটি ডিজাইনের বিষয়।