- গেল বছর ২৫ লাখ কেজি রফতানি করে ৪৫৯.৫৮ মিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন
- চলতি বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১০ কোটি ৩০ লাখ কেজি
বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের চা রফতানি দ্রুত বাড়ছে। ২০১৮ সালের পর গেল বছর ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ পরিমাণ ২.৪৫ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রফতানি হয়েছে।
এই রফতানি মূলত পাকিস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস, ডেনমার্ক, ফ্রান্স এবং স্পেনের মতো দেশগুলোতে হয়েছে। যদিও ২০২৩ সালে দেশের চা উৎপাদন রেকর্ড এক কোটি ২৯ লাখ ৮১ হাজার কেজি হয়েছিল, ২০২৪ সালে তা কিছুটা কমে যায়।
তবে রফতানি বাড়লেও ২০২৫ সালের জানুয়ারি-জুন প্রথম প্রান্তিকে আগের বছরের তুলনায় উৎপাদন কমেছে গড় ৮ শতাংশ। প্রথম ছয় মাসে উৎপাদন কিছুটা কমলেও জুলাই-অক্টোবর প্রান্তিকে উৎপাদন বেড়েছে বলে আশা করছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। জুলাই-অক্টোবর প্রান্তিকের প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত হয়নি।
চলতি বছরের তথ্যানুযায়ী, চা উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। যদিও উৎপাদন বেড়েছে এবং রফতানিও বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে দেশের চাহিদা মেটানো এবং রফতানি আরো বাড়ানোর ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব ও শ্রমিক সঙ্কট প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এখনো।
চা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০০১-২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর এক কোটি থেকে এক কোটি ২০ লাখ কেজি চা রফতানি করতো বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিগত ১৭ বছর নানা অব্যবস্থাপনা, সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির কারণে চা রফতানি খাতের অবনতি হতে থাকে। সে ধারাবাহিকতায় রফতানি থেকে ১০ লাখ কেজির ঘরে নেমে আসে। কিন্তু ২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর চা রফতানি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে।
তথ্য মতে, ২০২৪ সালে চা রফতানি আগের বছরের তুলনায় ৫৭.৫৫ শতাংশ বা ১৪ লাখ কেজি বেড়ে ২৪ লাখ ৫০ হাজার কেজিতে পৌঁছেছে। এতে আয় হয়েছে ৪৫৯.৫৮ মিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা। গত ছয় বছরের মধ্যে এটি ছিল সর্বোচ্চ পরিমাণ চা রফতানি।
চা বোর্ডের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০২৫ সালের প্রাথমিক তথ্য রফতানি আয়ে পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বছরের প্রথম তিন মাসে প্রতি কেজি চায়ের গড় রফতানিমূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫৬.২৬ টাকা। যেটা ২০২৩ সালে ছিল ১৫০-১৬০ টাকা। দেশে নিলামে প্রতি কেজি চা ১৭০-১৯০ টাকায় বিক্রি হলেও রফতানিতে এর দাম প্রায় ২৬০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতি কেজিতে ৪০-৫০ টাকা বেশি দামে রফতানি করা যাচ্ছে।
চা রফতানিকারকরা জানান, বাংলাদেশ থেকে মূলত কালো ও সবুজ চা রফতানি হয়, যার মধ্যে কালো চায়ের পরিমাণ বেশি। এক সময় আমদানি নির্ভর হলেও এখন অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পর উদ্বৃত্ত চা বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে। উৎপাদন বাড়লে রফতানিও বাড়বে বলে আশা তাদের।
সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, দেশে চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম ধরা হয় জুন-অক্টোবর পর্যন্ত সময়কে। বর্ষায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতে প্রকৃতিনির্ভর এ উৎপাদন ব্যবস্থা গতি পায়। চলতি বছরের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত দেশে চা উৎপাদন হয়েছে দুই কোটি ২৪ লাখ ৯১ হাজার কেজি। গত বছরের একই সময় এর পরিমাণ ছিল দুই কোটি ৪৩ লাখ পাঁচ হাজার কেজি। এর আগে ২০২৩ সালের জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত দেশে চা উৎপাদন হয়েছিল দুই কোটি ৬৫ লাখ ৫১ হাজার কেজি।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের মাসভিত্তিক উৎপাদন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সর্বশেষ জুনে দেশে চা উৎপাদন হয়েছে ৯৮ লাখ ২৫ হাজার কেজি। গত বছরের একই সময় মোট চা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল এক কোটি ২৮ লাখ ৩৭ হাজার কেজি।
জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দেশের বাগানগুলো থেকে চা পাতা সংগ্রহ বন্ধ করা হয়। এ সময় বাগান পরিচর্যা, প্রুনিং বা গাছের ওপরের অংশ ছাঁটাই করে পরবর্তী মৌসুমের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এরপর বর্ষা মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিপাত থেকে বাগানে নতুন কুঁড়ি জন্মানো শুরু হলে তা থেকে ভালোমানের চা উৎপাদন হয়। এ কারণে বছরের প্রথম দুই-তিন মাস চা উৎপাদন কম হয়। যদিও মার্চ থেকে তা আবার বাড়তে থাকে। জুনে উৎপাদন ছয় মাসের সর্বোচ্চে পৌঁছে।
বাংলাদেশ চা বোর্ডসূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে দেশে রেকর্ড ১০ কোটি ২৯ লাখ ১৮ হাজার কেজি চা উৎপাদন হয়। পরের বছর ২০২৪ সালে উৎপাদন কিছুটা কমে ৯ কোটি ৩০ লাখ ৪২ হাজার কেজিতে নেমে আসে। চলতি বছর ১০ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে জুন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় উৎপাদন কিছুটা কমেছে।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের চা রফতানি হচ্ছে মূলত ৯টি দেশে। দেশগুলো হচ্ছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস, ডেনমার্ক, ফ্রান্স ও স্পেন। এর বাইরেও কিছু দেশে বাংলাদেশের চা রফতানি হয়ে থাকে। বর্তমানে দেশের চা রফতানিকারীদের মধ্যে রয়েছে ফিনলে টি, এইচআরসি গ্রুপ, এমএম ইস্পাহানি লিমিটেড, আবুল খায়ের কনজিউমার প্রডাক্টস লিমিটেড, কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেড এবং হালদা ভ্যালি টি এস্টেট লিমিটেড।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চা সংসদের সভাপতি কামরান টি রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল চা উৎপাদন। যদিও উৎপাদন খরচ তুলে আনা ও বাগানকে লাভজনক করতে হলে বিকল্প সেচ দিয়েও উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব। তবে সম্প্রতি তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে চা উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, দেশের চা খাতে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি ও লোকসান এড়ানোর মাধ্যমে বাগানগুলোকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি স্থানীয় চাহিদা পূরণ ও রফতানিমুখী খাতটিকে শক্তিশালী করতে সরকারের বিশেষ নজর দেয়া জরুরি।



