দোয়ারাবাজারে চোরাই ব্যবসার হটস্পট বাংলাবাজার সীমান্ত

প্রতিদিন আসছে ভারতীয় গরু-মহিষ, বৈধতা দিচ্ছে পশুর হাট

আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে একটি সিন্ডিকেট বাজারটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। কয়েক বছর আগে যেখানে ইজারা নিতে অনীহা ছিল স্থানীয়দের, সেখানে চোরাই ব্যবসা জমজমাট হওয়ায় এখন ইজারা নেয়ার প্রতিযোগিতা চলে।

সোহেল মিয়া, দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ)
Printed Edition
চোরাইপথে আসা গরু
চোরাইপথে আসা গরু |নয়া দিগন্ত

সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার সীমান্ত এখন চোরাকারবারিদের জন্য নিরাপদ হটস্পটে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন অবৈধ পথে ভারতীয় গরু-মহিষ পাচার হয়ে আসছে এ সীমান্ত দিয়ে। একই সাথে বাংলাদেশ থেকে মাছসহ বিভিন্ন পণ্য পাচার হচ্ছে ভারতে। এসব চোরাই গরু-মহিষকে বৈধতা দিচ্ছে স্থানীয় বাংলাবাজার পশুর হাট।

দোয়ারাবাজার উপজেলার সবচেয়ে বড় বাজার বাংলাবাজার। প্রতিবছর দেশীয় পশু ক্রয়-বিক্রয়ের নামে ইজারা দেয়া হয় হাটটি। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে একটি সিন্ডিকেট বাজারটির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। কয়েক বছর আগে যেখানে ইজারা নিতে অনীহা ছিল স্থানীয়দের, সেখানে চোরাই ব্যবসা জমজমাট হওয়ায় এখন ইজারা নেয়ার প্রতিযোগিতা চলে।

চলতি বছর পহেলা বৈশাখে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকায় হাটটি ইজারা দেয়া হয়। অথচ আশপাশেই রয়েছে আরো তিনটি বড় পশুর হাট। পশ্চিমে বোগলাবাজার, পূর্বে নরসিংপুর ও উত্তরে দোয়ারাবাজার উপজেলার সবচেয়ে বড় বালিউড়া হাট। ফলে স্থানীয়দের সীমিত উপস্থিতি ছাড়া বাংলাবাজার হাটে আগে তেমন ভিড় থাকত না। এখন চোরাই গরু-মহিষের কারণে জমজমাট হয়ে উঠছে হাটটি।

অভিযোগ আছে, এ সিন্ডিকেট কোটি কোটি টাকার সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে রাতারাতি বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। ইজারার টাকার আড়ালে মূলত চোরাই গরু-মহিষকে বৈধ করার ব্যবসাই চলে এখানে।

বাংলাবাজার ইউনিয়নের সীমান্তজুড়ে রয়েছে তিনটি বিজিবি ক্যাম্প- সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়নের বাঁশতলা ও পেকপাড়া বিওপি এবং সিলেট ব্যাটালিয়নের বাংলাবাজার বিওপি। এত ঘন নিরাপত্তার পরও প্রতিরাতে সীমান্ত দিয়ে অবাধে প্রবেশ করছে গরু-মহিষ এবং পাচার হচ্ছে নানান চোরাই পণ্য।

এসব পশু ও পণ্য সীমান্ত অতিক্রমের পর গাড়িযোগে নরসিংপুর ইউনিয়নের ব্রিটিশ পয়েন্ট হয়ে উপজেলা সদর অতিক্রম করে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। আবার একই পথে বাংলাদেশ থেকেও বিভিন্ন পণ্য পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারতে।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, সীমান্তের পানি নিষ্কাশন পোল, ড্রেন, সুড়ঙ্গ ও কাঁটাতারের গোপন পথ ব্যবহার করে রাতের অন্ধকারে গরু-মহিষ আনা হয়। প্রতিটি পশুর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্যদের নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দেয়া হয়।

এ কাজে নিয়োজিত থাকে স্থানীয় এজেন্ট ও চোরাই শ্রমিকরা। তারা প্রতিটি গরু কিংবা প্রতিটি মহিষ বাংলাদেশে নিয়ে আসার পর পান এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। সীমান্ত পার হওয়ার আগেই চোরাকারবারি সিন্ডিকেট হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে স্থানীয় হাটের হাসিল রশিদ পেয়ে যায়।

বাংলাবাজারে এসে হাটের ইজারাদারের কাছ থেকে গরুপ্রতি দেড় হাজার টাকা এবং মহিষপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা দিয়ে হাসিল রশিদ সংগ্রহ করে নেন। এ রশিদ দেখিয়ে দেশব্যাপী চোরাই গরু-মহিষ বৈধ হিসেবে বিক্রি করতে পারেন তারা। ফলে সরকারি কাগজপত্রে সবকিছু বৈধ মনে হলেও বাস্তবে এসব চোরাই ব্যবসার বৈধতা মাত্র।

চোরাচালান দমনে বিজিবি ও পুলিশ সম্প্রতি তৎপরতা বাড়িয়েছে। প্রায়ই অভিযান চালিয়ে আটক হচ্ছে চোরাই গরু-মহিষ। সর্বশেষ গত সোমবার রাতে বাঁশতলা সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু প্রবেশের সময় চোরাকারবারিদের উদ্দেশে ফাঁকাগুলি ছোড়ে বাংলাবাজার বিজিবির টহল দল। পরে বিশেষ অভিযানে সাতটি গরু জব্দ করা হয়। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি।

সিলেট ব্যাটালিয়ন (৪৮ বিজিবি) অধিনায়ক লে. কর্নেল নাজমুল হক বলেন, চোরাই কারবার দমনে বিজিবির অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দিন-রাত টহল চলছে। তথ্য পেলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

স্থানীয়রা বলছেন, তিনটি বিজিবি ক্যাম্প থাকলেও কিভাবে প্রতিরাতে গরু-মহিষ ও পণ্য সীমান্ত অতিক্রম করছে- এটাই বড় প্রশ্ন। তারা মনে করেন, সিন্ডিকেটের সঙ্গে অসাধু প্রভাবশালী মহল ও কিছু দায়িত্বশীল ব্যক্তির যোগসাজশ ছাড়া এত বড় চোরাই কারবার চালানো সম্ভব নয়।

দোয়ারাবাজার সীমান্তের বাংলাবাজার এভাবে চোরাই ব্যবসার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়ায় সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। অথচ প্রশাসনের সক্রিয়তা বাড়লেই এ অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ।