২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গভীর ও রক্তাক্ত বাঁকবদলের সূচনা হয়। স্বৈরাচারী শাসন, দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং বিদেশী স্বার্থনির্ভর অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান দেশকে একটি নতুন ধারায় প্রবেশ করায়। ইতিহাসে ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে খ্যাত এই আন্দোলন ছিল কেবল ক্ষমতার রদবদল নয়; বরং একটি আদর্শগত বিচ্ছিন্নতার ঘোষণাপত্র, যার কেন্দ্রে ছিল জাতীয় সার্বভৌমত্ব, কৌশলগত স্বনির্ভরতা ও জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ।
কৌশলগত মুক্তির মৌলিক প্রশ্ন : কেন এবং কিভাবে?
এ বিপ্লব দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান পুনর্নির্ধারণের সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রশ্ন হলে-
এই বিপ্লব ভারতের অতিনির্ভরতা ও আধিপত্যবাদী হস্তক্ষেপ থেকে মুক্তির বাস্তব ভিত্তি গড়ে তুলতে পেরেছে কি?
চীনা প্রভাবের জালে জড়িয়ে না গিয়ে কিভাবে ভারসাম্যপূর্ণ কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষা সম্ভব?
কূটনৈতিক বহুমুখীকরণ এবং জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ও সামরিক নীতি কিভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে?
১. অতীতের নিয়ন্ত্রণ চক্র : এক অপ্রকাশিত উপনিবেশের বাস্তবতা
ভারতের একতরফা আধিপত্য
পানি ও পরিবেশ : তিস্তা, গোমতী, দুধকুমারসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টনে ভারতের একতরফা অবস্থান দেশের খাদ্য ও কৃষি নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে।
সীমান্ত হত্যা ও নিরাপত্তা নীতি : বিএসএফ কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশীদের হত্যা এবং সীমান্তে অনুপ্রবেশের অবাধতা বাংলাদেশকে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিতে ঠেলে দিয়েছে।
RAW, NSG প্রভাব : বাংলাদেশে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা খাতে ভারতের অতিমাত্রিক উপস্থিতি স্বাভাবিক নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় বিদেশী হস্তক্ষেপের দৃষ্টান্ত।
চীনের কৌশলগত হেজিমনি
ঋণ ফাঁদ ও BRI নির্ভরতা : চীনা প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতা ও স্থায়িত্বের অভাব বাংলাদেশের ওপর ঋণচাপ বাড়িয়েছে এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হ্রাস করেছে।
টেলিকম, অবকাঠামো ও সামরিক প্রযুক্তিতে চীনা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ : বিশেষত ICT খাতে চীনা কোম্পানিগুলোর আধিপত্য জাতীয় সাইবার নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
পশ্চিমা প্রভাব ও করপোরেট নীতি
বিশ্বব্যাংক-IMF এর ‘নব্য ঔপনিবেশিক’ নীতি বাংলাদেশের স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করেছে।
বেসরকারীকরণ ও গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতের শোষণ : উৎপাদনে নয়, মধ্যস্বত্বভোগী ও বিদেশী কোম্পানির মুনাফাকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় জাতীয় জ্বালানিনীতি।
২. জুলাই বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া : নীতিগত পরিবর্তনের সূচক
নতুন পররাষ্ট্রনীতি : জনভিত্তিক কূটনীতি
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদেশী চুক্তিতে নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী ও শিক্ষিত তরুণদের পরামর্শ অন্তর্ভুক্তির নীতি গ্রহণ করেছে।
প্রতিটি চুক্তি ও বিনিয়োগে ‘উভয়পক্ষের লাভ’ ও ‘জবাবদিহিতা’ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
কৌশলগত বহুমুখীকরণ
সামরিক খাতে একক নির্ভরতার বদলে তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, পূর্ব ইউরোপ, ব্রাজিল, পাকিস্তান প্রভৃতি উৎস বিবেচনায় আনা হচ্ছে।
ICT, বিদ্যুৎ ও টেলিকম খাতে জাপান, ইইউ, ASEAN-এর সাথে সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে তোলা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার কর্মপন্থা
ব্যাংক খাত ও শেয়ারবাজার পুনর্গঠন : অবৈধ ঋণ ও লুটপাট বন্ধে কম্প্রিহেনসিভ রিফর্ম।
দুর্নীতিমুক্ত শিল্পনীতি : দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে বহুমুখীকরণ।
৩. ভবিষ্যতের কৌশলগত মুক্তির কর্মপন্থা
কূটনৈতিক ভারসাম্য- ভারত ও চীনের সাথে স্বার্থকেন্দ্রিক সম্পর্ক; সংবেদনশীল বিষয়ে নিরপেক্ষতা; জাতিসঙ্ঘভিত্তিক নিরাপত্তা কাঠামো
সামাজিক-জনমত ভিত্তিক নীতি; কৌশলগত ইস্যুতে জনমত জরিপ, সংসদীয় গণশুনানি ও নাগরিক পর্যবেক্ষণ; নিরাপত্তা ও চুক্তির স্বচ্ছতা; রাষ্ট্রীয় গোপন চুক্তিতে সংসদীয় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা; প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কার- অর্থনৈতিক কমিশন, কৌশল গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি কাউন্সিল গঠন।
৪. ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতা
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভাজন : বিদেশী শক্তির আগ্রাসনের সুযোগ তৈরি হতে পারে।
নির্বাচনী প্রতারণা ও পুনরায় বিদেশ-অনুগত সরকারের প্রত্যাবর্তন : বিপ্লবোত্তর নীতিমালা বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা।
বহুপক্ষীয় দ্বন্দ্ব : ভারত-চীন প্রতিযোগিতা বা প্রশান্ত-মহাসাগরীয় ভূ-রাজনৈতিক সংঘর্ষে চাপে পড়তে পারে বাংলাদেশ।
৫. মুক্তির যাত্রা শুরু, সমাপ্ত নয়
জুলাই বিপ্লব একটি কৌশলগত জাগরণের নাম। এটি বুঝিয়েছে- গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন নয়, তা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের বাস্তবায়ন। তবে এই মুক্তি আত্মপ্রকাশ করতে পারে কেবল তখনই, যখন জনগণ থাকবে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের কেন্দ্রে।
এই বিপ্লব কেবল ‘শুরু’; গন্তব্য এখনো বহুদূর। একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণভিত্তিক, আত্মনির্ভর ও কৌশলগতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এই সংগ্রাম চলতেই হবে- নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং কূটনৈতিক সচেতনতার মাধ্যমে।