বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩২.১৮ বিলিয়ন ডলার

দীর্ঘদিন ধরে রিজার্ভ ঘিরে যে উদ্বেগ ও চাপ তৈরি হয়েছিল, এই অগ্রগতি তা অনেকাংশে প্রশমিত করেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত কড়াকড়ি, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে শৃঙ্খলা ফেরানোর ফলেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

  • অর্থনীতিতে স্বস্তির ইঙ্গিত

  • নীতিগত ব্যবস্থার ইতিবাচক প্রভাব

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারো ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরেছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দীর্ঘদিন ধরে রিজার্ভ ঘিরে যে উদ্বেগ ও চাপ তৈরি হয়েছিল, এই অগ্রগতি তা অনেকাংশে প্রশমিত করেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিগত কড়াকড়ি, রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধে শৃঙ্খলা ফেরানোর ফলেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বৈদেশিক মুদ্রার পাচার বেড়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মদদে একশ্রেণীর লুটেরা জনগণের আমানত লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ অস্বাভাবিক হারে কমতে থাকে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বৈদেশিক মুদ্রার পাচার অনেকাংশেই কমে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। হুন্ডি নিয়ন্ত্রণে জোরদার পদক্ষেপ, বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রণোদনা এবং মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানোর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। পাশাপাশি রফতানি আয়ও ধীরে ধীরে স্থিতিশীল ধারায় ফিরছে, যা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার একটি প্রধান সূচক। আমদানি ব্যয় মেটানো, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পর্যাপ্ত রিজার্ভ অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশের কাছে কমপক্ষে তিন থেকে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকা প্রয়োজন। বর্তমান রিজার্ভ সেই সীমা অতিক্রম করায় অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরছে।

এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় নতুন কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানা গেছে। স্বল্পসুদে ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়ার দিকে ঝোঁক বাড়ানো এবং স্বল্পমেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণ কমানোর ফলে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে ঋণের কিস্তি পরিশোধে সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, রিজার্ভ বাড়ার এই ধারা ধরে রাখতে হলে কাঠামোগত সংস্কার আরো জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে রফতানি খাতের বহুমুখীকরণ, নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং প্রবাসী কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি জরুরি। একই সাথে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত না হলে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, রিজার্ভ শক্তিশালী হলে আমদানি এলসি খুলতে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে কমবে। এতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি সহজ হবে এবং উৎপাদন খাতে গতি ফিরবে। পাশাপাশি ডলারের দামে অস্থিরতাও কিছুটা কমতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে।

সব মিলিয়ে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২.১৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করছে। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে নীতিগত শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা এবং টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। সাময়িক স্বস্তিতে আত্মতুষ্ট না হয়ে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকার্যক্রম অব্যাহত রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।