৩৭ কুয়েট ছাত্র বহিষ্কার, মামলা : হলে প্রবেশ

ভিসির পদত্যাগ দাবি, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

এরশাদ আলী, খুলনা ব্যুরো
Printed Edition
কুয়েটের এম এ রশীদ হলের ফটকের তালা ভেঙে প্রবেশ করছেন শিক্ষার্থীরা
কুয়েটের এম এ রশীদ হলের ফটকের তালা ভেঙে প্রবেশ করছেন শিক্ষার্থীরা |নয়া দিগন্ত

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাছুদের পদত্যাগ দাবি করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারে প্রেস ব্রিফিংয়ের তারা এ ঘোষণা দেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি আবাসিক হলের তালা ভেঙে সেগুলোতে প্রবেশ করেন। এর আগে সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভায় সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেইসাথে আগামী ২ মে থেকে সব আবাসিক হল খুলে দেয়া ও ৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষাকার্যক্রম শুরুর সিদ্ধান্ত হয়।

গতকাল শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের ঘোষণায় বলেন, যেহেতু ভিসি কুয়েট শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন ও এর দায় নিতে অস্বীকার করেছেন, নেট, পানি অফ করে হল থেকে বের করে দিয়েছেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দিতে ইন্ধন জুগিয়েছেন এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করেছেন, সেহেতু আমরা ছয় দফা থেকে এক দফা ঘোষণা করছি। এ ভিসিকে অপসারণ আমাদের একমাত্র দাবি। একই সাথে নতুন ভিসির অধীনে নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে তদন্তের দাবি জানাচ্ছি। ঘোষণাপত্র পাঠ করার পর তারা হলগুলোর তালা খুলে প্রবেশ করার ঘোষণা দিয়ে মিছিল নিয়ে খান জাহান আলী হলের দিকে যান। সেখানকার প্রধান ফটকের তালা এবং এরপর বাকি পাঁচটি আবাসিক হলের তালা ভাঙেন। এর আগে ক্যাম্পাসের ভাস্কর্য দুর্বার বাংলার পাদদেশে ছাত্ররা ‘মেক কুয়েট, ফ্রি অ্যাগেইন’ কর্মসূচি পালন করেন। সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আয়োজিত এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। বিক্ষোভ প্রদর্শন শেষে শিক্ষার্থীরা অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোর সামনে গিয়ে হ্যান্ডমাইকে শিক্ষকদের কাছে হলে ঢুকতে সহায়তা করার আহ্বান জানান।

তারা বলেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদল ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হামলায় ১৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী আহত হন। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা বিচারের দাবি করলে দুই মাস পর ৪২ জন প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়। আর শেষে সোমবার সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তেও প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদেরও বহিষ্কারের নির্দেশ দেয়া হয়। আমরা এসব নাটক আর সহ্য করব না। তিন দিন ধরে আমরা খোলা আকাশের নিচে মশার কামড় খেয়ে কষ্ট সহ্য করছি।

আন্দোলনরত রাহাতুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এক দফা ঘোষণা করে ভিসির পদত্যাগ চেয়েছি। তিনি সবক্ষেত্রে ব্যর্থ। যাদের শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল, তাদের কিছু হয়নি। উল্টো আন্দোলনকারীদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে দুই রাত খোলা আকাশের নিচে থাকতে বাধ্য করেছে। আজ আমরা ছেলেদের হলের তালা ভেঙেছি। মেয়েদের একটি হল তালাবদ্ধ। মেয়েরা এলেই ওই হলের তালা ভাঙা হবে। হলগুলোতে বিদ্যুৎ, পানি ও ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার জন্য আমরা আবেদন করব ।

অপরদিকে তদন্ত কমিটির একটি সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে যে ৩৭ ছাত্রকে শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট গ্রহণ করে ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটিকে সাময়িক বহিষ্কার কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছে, তারা শুধু আন্দোলনকারী নয়, এর মধ্যে হামলাকারী ছাত্রদলের কর্মীরা তো রয়েছেই, সেইসাথে আন্দোলন করার সময় শিক্ষকদের পেটানোর মতো জঘন্য কাজ করেছে এমন কয়েকজন আন্দোলনকারী ছাত্র রয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৮ ফেব্রুয়ারি কুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় শতাধিক আহত হন। পরদিন প্রশাসনিক ভবনসহ সব অ্যাকাডেমিক ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। ওই দিন দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় কুয়েটে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি সব আবাসিক হল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য গঠিত কমিটি গত রোববার রাতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর সোমবার রাতে সে রিপোর্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১তম (জরুরি) সিন্ডিকেট সভায় বসে।

ঢাবি ও বুয়েটে বিক্ষোভ : কুয়েট ভিসির পদত্যাগের এক দফা দাবির সাথে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেলে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীদের ‘কুয়েট তোমার ভয় নাই, জুলাই আমরা ভুলি নাই,’সহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। সংক্ষিপ্ত সমাবেশ শেষে বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাসে প্রদক্ষিণ করে তারা।

সমাবেশে ঢাবি শিক্ষার্থী ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক এ বি জোবায়ের বলেন, কুয়েটের শিক্ষার্থীরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমরা তার সাথে একাত্মতা পোষণ করছি। আমরা কুয়েট ভিসির অপসারণের দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করছি। দালাল মাসুদের পদত্যাগ চাই। এই ভিসিকে পদত্যাগ করে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে হবে। অবিলম্বে যদি এ ভিসি পদত্যাগ না করে, শুধ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় দেশের সব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলব।

বুয়েটে মানববন্ধন : কুয়েটে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, মিথ্যা মামলা ও বহিষ্কারের প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে বুয়েট শহীদ মিনারের সামনে গতকাল দুপুরে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বুয়েটের ২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী ফারাবী ও আরমা। এ সময় কুয়েট প্রশাসনের বিতর্কিত ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার, প্রকৃত দোষীদের শাস্তি এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। বিজ্ঞপ্তিতে বুয়েটের শিক্ষার্থী বলেন, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে কুয়েট ক্যাম্পাসে বিএনপিপন্থী ও ছাত্রদল সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদের হামলায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। হামলার প্রকৃত তদন্ত শেষ না হতেই দুই মাস পর কুয়েট প্রশাসনের সহযোগিতায় আন্দোলনে অংশ নেয়া নিরীহ ২২ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। যেটি সম্পূর্ণভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত বলে অভিহিত করেছেন। এ মামলা কেবল ২২ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে নয়, এটি দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অধিকার হরণের চেষ্টা। রাজনৈতিক স্বার্থে শিক্ষাঙ্গনের নিরীহ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের দমন কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

ইবিতে সমাবেশ

ইবি প্রতিনিধি জানান, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (কুয়েট) ৩৭ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের প্রতিবাদ জানিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ৩টায় বিশ^বিদ্যালয়ের বটতলায় এ সমাবেশ করেন তারা। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ইবি সমন্বয়ক এস এম সুইট, সহ-সমন্বয়ক নাহিদ হাসান, ইয়াশিরুল কবির সৌরভ, তানভির মণ্ডল ও গোলাম রাব্বানীসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিবাদ সমাবেশে সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন, ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে কুয়েট ভিসির সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল শিক্ষার্থীদের। কিন্তু তিনি একটি দল বা গোষ্ঠীকে সব সময় সুযোগ সুবিধা দিয়েছেন। কুয়েট ভিসি সরাসরি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি তার চেয়ারে থাকার নৈতিকতা হারিয়েছেন। যিনি ছাত্রদের অধিকার সংরক্ষণ করতে পারেন না, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদে থাকতে পারেন না। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট অনতিবিলম্বে কুয়েট ভিসিকে অপসারণ করার আহ্বান জানাচ্ছি।’