বরিশালের ৬টি আসন

বিএনপির সাথে লড়তে ইসলামী দলগুলোর সমঝোতার সম্ভাবনা

আযাদ আলাউদ্দীন, বরিশাল ব্যুরো
Printed Edition

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বরিশালের ছয়টি আসনে রাজনৈতিক উত্তাপ এখন তুঙ্গে। বিএনপি এককভাবে মাঠে থাকলেও ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো- জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (ইসা) ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সমঝোতা ও সমন্বয়ের চেষ্টায় আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত।

বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) : এই আসনটি ঐতিহ্যগতভাবে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত হলেও এবার প্রতিযোগিতা ত্রিমুখী রূপ নিয়েছে। বিএনপির প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন। তবে দলের ভেতরের সাম্প্রতিক কোন্দল, বিতর্কিত নেতাদের কর্মকাণ্ড ও সাম্প্রতিক বহিষ্কারাদেশ তার জনপ্রিয়তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের ধারণা।

ইতোমধ্যে টানা এক বছর মাঠে প্রচারণা চালিয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হাফেজ মাওলানা কামরুল ইসলাম খান শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুহাম্মদ রাসেল সরদার মেহেদী এবং এনসিপির মাজহারুল ইসলাম নিপুকে ঘিরেও এলাকায় আলাপ-আলোচনা জোরালো হয়ে উঠছে। ইসলামী দলের প্রার্থীরা সমঝোতায় উপনীত হলে বিএনপি প্রার্থীর বিজয় কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) : বরিশালের সবচেয়ে আলোচিত আসনগুলোর একটি বরিশাল-২। দীর্ঘ গঠনতান্ত্রিক দুর্বলতার পর বিএনপি এখানে একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামলে নিয়ে প্রার্থী করেছে সাবেক সংসদ সদস্য এস সরফুদ্দিন আহমেদকে (সান্টু)। তবে তার কয়েকটি স্ববিরোধী বক্তব্য নির্বাচনী মাঠে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ফলে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন জামায়াতের প্রার্থী মাস্টার আব্দুল মান্নান এবং ইসলামী আন্দোলনের মাওলানা মুহাম্মদ নেছার উদ্দীন।

জামায়াতের মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, লিফলেট বিতরণ ও ডোর-টু-ডোর কর্মসূচি ইতোমধ্যে এলাকায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ইসলামী আন্দোলনও সুশৃঙ্খলভাবে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। স্থানীয়দের মতে- ইসলামী দলগুলোর ভোট একত্র হলে বিএনপি এই আসনে কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়বে।

বানারীপাড়ার চাখার ও উজিরপুরের সাতলা ঘুরে দেখা গেছে, জনমতের একটি বড় অংশই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুকূলে মতামত দিচ্ছেন।

বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) : এই আসনটিতে বিএনপির অভ্যন্তরীণ মনোনয়ন-দ্বন্দ্বই এখন মূল আলোচ্য বিষয়। একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী সক্রিয় থাকায় এখনো চূড়ান্ত হয়নি দলের মনোনয়ন। ফলে তৃণমূলে বিভ্রান্তি ও বিভাজনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

অন্য দিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আগেই প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠে নেমেছে। বরিশাল মহানগর জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর প্রতিদিনই গণসংযোগ করে আলোচনায় রয়েছেন। স্থানীয়দের কাছে তিনি ইতোমধ্যে জনপ্রিয় মুখ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা মুহাম্মাদ সিরাজুল ইসলামও সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। দুই দলের ভোট যদি একত্র হয়, ইসলামপন্থীরা এই আসনে এগিয়ে থাকবে- এমনটাই মনে করছেন ভোটাররা।

এ দিকে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদও নিয়মিত সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আলোচনায় রয়েছেন। মীরগঞ্জ সেতুসহ জনদাবি তুলে ধরে তিনি এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন।

বিএনপি প্রভাবিত এই আসনে মনোনয়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বেগম সেলিমা রহমান ও আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের অভ্যন্তরীণ টানাপড়েনের কারণে এখনো কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। পাশাপাশি ব্যারিস্টার মনিরুজ্জামান আসাদ ও আবদুস সাত্তার খানও মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় আছেন।

বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) : নদীবেষ্টিত এই আসন বরাবরই ইসলামী দলের শক্ত ঘাঁটি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় হয়েছিল। পরে ইউনিয়ন পরিষদেও একাধিকবার জয় পেয়েছে দলটি। সেই সম্ভাবনা মাথায় রেখে মসজিদ-মাদরাসাভিত্তিক প্রচারণা জোরদার করেছেন তারা।

বিএনপির প্রার্থী রাজীব আহসান গণসংযোগ শুরু করলেও দলের ভেতরকার সমন্বয় দুর্বল বলে অভিযোগ রয়েছে। সাবেক সংসদ সদস্য মেজবাহ উদ্দিন ফরহাদ এবং ব্যারিস্টার মাসুম মনোনয়ন না পাওয়ায় তাদের অনাগ্রহ ও হতাশা মাঠপর্যায়ে প্রভাব ফেলছে।

এই সুযোগে জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা আবদুল জব্বার অনেকটাই এগিয়ে আছেন। অন্য দিকে ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ আবুল খায়েরও প্রার্থী হতে চান। হাতপাখা ও দাঁড়িপাল্লার সমঝোতা হলে ইসলামপন্থীদেরই এখানে বাড়তি সুবিধা মিলবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।

বরিশাল-৫ (বরিশাল সদর) : বরিশাল সদরকেন্দ্রিক হওয়ায় এ আসনে প্রতিযোগিতাও সবচেয়ে জটিল। বিএনপির শক্ত প্রার্থী থাকলেও দলীয় নেতৃত্বসঙ্কট ও বিভাজন নির্বাচনী মাঠে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সরাসরি সম্পৃক্ততায় তাদের প্রচারণা দৃশ্যমান ও ভোটারদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ তাদের শক্তি বাড়িয়েছে। জামায়াতে ইসলামীও প্রায় তিন হাজার মোটরসাইকেলের শোডাউন করে সবাইকে চমক লাগিয়ে দিয়েছে।

বিএনপি থেকে প্রার্থী সাবেক মেয়র ও সংসদ সদস্য আইনজীবী মজিবর রহমান সরোয়ার। জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অ্যাডভোকেট মুয়াযযম হোসাইন হেলাল। ইসলামী আন্দোলনের সম্ভাব্য প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করিম। মর্যাদার এই আসনে ইসলামী দলগুলোর সমঝোতা হলে লড়াইয়ের রূপরেখা বদলে যেতে পারে।

বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) : ১৪টি ইউনিয়নের সমম্বয়ে গঠিত এ আসনে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের ত্রিমুখী লড়াইয়ের আভাস মিলছে। বিএনপির প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য আবুল হোসেন খান এলাকায় দীর্ঘ দিনের পরিচিত মুখ। তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা স্থায়ী ভোট-ভিত্তি তৈরি করেছে দলটির জন্য। তবে ইসলামী দলগুলো গ্রামীণ নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে নিভৃতে প্রচারণা চালাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম এখানেও প্রার্থী হবেন। জামায়াতের পক্ষে মাওলানা মাহমুদুন্নবীও দুধল, দাড়িয়াল ও চরাদি এলাকায় বেশ জনপ্রিয় ও সক্রিয়। এসব অঞ্চলে ইসলামী দলের প্রভাব দৃশ্যমান।

রাজনৈতিক সমীকরণ : ধর্মভিত্তিক দলগুলোর উত্থান বরিশালের ছয়টি আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে জটিল করে তুলেছে। মসজিদকেন্দ্রিক প্রচারণা, যুবসমাজের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ এবং মাঠপর্যায়ে নীরব সংগঠনের কারণে ইসলামী দলগুলো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। অন্য দিকে বিএনপির ঐতিহ্যগত ভোটব্যাংক থাকলেও মনোনয়ন নিয়ে বিভ্রান্তি, অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও প্রচারণা-সমন্বয়ের ঘাটতি তাদেরকে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

সবমিলিয়ে বরিশালের ছয়টি আসনেই আগামী নির্বাচন হতে যাচ্ছে সমান লড়াইয়ের। প্রচারণা যত বাড়বে, উত্তাপও তত বাড়বে- এমনটাই মনে করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।