আইনগত ভিত্তি ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি ছাড়াই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ চূড়ান্ত করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত সনদের কপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। সমন্বিত খসড়ার সাথে চূড়ান্ত সনদে বেশ কয়েকটি পার্থক্য রয়েছে। সনদের অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত থাকবে। খসড়ায় বলা হয়েছিল সনদের বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা, কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কিন্তু চূড়ান্ত সনদে বলা হয়েছে, স্বারকারী দলগুলো কোনো প্রশ্ন তুলবে না। গণ-অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হবে। বাস্তবায়নের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলো দ্রুতই অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ সম্পূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করবে। আগে যেসব দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিল, তাদের নাম উল্লেখ ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত সনদে দলের নাম উল্লেখ না করে শুধু সংখ্যা বলা হয়েছে। খসড়ায় ছিল এর কোনো বিধান শুধুমাত্র সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ব্যাখ্যা দিতে পারবে। কিন্তু চূড়ান্ত সনদে তা বাদ দেয়া হয়েছে। ঐকমত্য কমিশন বলছে, কোনো প্রশ্ন না করেই রাজনৈতিক দলগুলোকে সনদে স্বার করতে হবে। আর আইনগত ভিত্তি নিয়ে আগামী রোববার ফের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা করবে কমিশন। এরপর আলাদাভাবে সুপারিশ করবে তারা।
অঙ্গীকারনামা : অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে প্রকাশিত জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে অঙ্গীকার করছি :
(১) জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন য়তির বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং জন-আকাক্সার প্রতিফলন হিসেবে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।
(২) জনগণ এই রাষ্ট্রের মালিক। তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। তাই রাজনৈতিক দল ও জোট সম্মিলিতভাবে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ গ্রহণ করেছি। ফলে এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করব।
(৩) জুলাই সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমরা কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করব না। উপরন্তু সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরা নিশ্চিত করব।
(৪) আমরা ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করব।
(৫) গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।
(৬) সনদে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান। বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব।
(৭) এই মর্মে একমত, জুলাই সনদ ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো দ্রুত সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।
প্রথম অংশে সনদের পটভূমিতে পাঁচটি প্রস্তাবনা, দ্বিতীয় অংশে ঐকমত্য হওয়া ৮৪টি সিদ্ধান্ত এবং তৃতীয় অংশে সাতটি অঙ্গীকার রয়েছে। আবার ঐকমত্য হওয়া ৮৪টির মধ্যে আংশিক ও পূর্ণমিলিয়ে ২৮টি নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- প্রধানমন্ত্রী হলে দলীয় পদে থাকা যাবে না। রাষ্ট্রের সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে যেসব সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ আলোচনায় ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। তবে ২৮টি সিদ্ধান্তে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিভিন্ন দল। এর মধ্যে মৌলিক সংস্কার ১৯টি। তবে কারা নোট ডিসেন্ট দিয়েছে, তাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। ঐকমত্যে পৌঁছানো বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব ও সংবিধান। এ ছাড়াও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং মৌলিক অধিকারের বিষয়ে যেসব প্রস্তাবে সম্মিলিতভাবে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো হলো- ১. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ২. নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ৩. রাষ্ট্রপতির মা-সম্পর্কিত বিধান, ৪. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ- (ক) সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ। ৫. জরুরি অবস্থা ঘোষণা, ৬. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, ৭. সংবিধান সংশোধন, ৮. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, ৯. নির্বাচন কমিশন গঠন, ১০. পুলিশ কমিশন গঠন, ১১. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত। এ ছাড়া বাকি ৯টি বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ (ভিন্নমত) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এগুলো হলো- ১. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ সংশোধন, ২. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, ৩. সরকারি কর্মকমিশন, মহাহিসাব নিরীক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সম্পর্কিত ৪. সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব (সংখ্যা বৃদ্ধি, নির্বাচনপদ্ধতি ইত্যাদি); ৫. দ্বিকবিশিষ্ট আইনসভা (উচ্চকরে গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি), ৬. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ৭. তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ৮. রাষ্ট্রের মূলনীতি, ৯. রাষ্ট্রপতির মতা ও দায়িত্ব (অনুচ্ছেদ ৪৮(৩))।
সংবিধান সংশোধন : সংবিধান সংশোধনের েেত্র সংসদের উভয় করে (নিম্নক ও উচ্চক) দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন হইবে। তবে সুনির্দিষ্ট কতগুলো অনুচ্ছেদ যেমন ৮, ৪৮, ৫৬, ১৪২ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, (যেটি সংবিধানে যুক্ত হবে তা) সংশোধনের েেত্র গণভোটের প্রয়োজন হবে। এেেত্র ৩০টি দল ও জোট একমত।
জরুরি অবস্থা ঘোষণা : ১) জরুরি অবস্থা ঘোষণার েেত্র ১৪১ক অনুচ্ছেদ সংশোধনের সময় ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগের’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি বা মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে। (২) যুক্ত হবে জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বারের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান। জরুরি অবস্থা ঘোষণা সম্পর্কিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা অথবা তার অনুপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় উপনেতার উপস্থিতি অন্তর্ভুক্ত হবে।
নাগরিক পরিচয় : দেশের নাগরিকরা ‘বাংলাদেশি’ বলে পরিচিত হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’ উল্লেখ থাকবে। সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও মর্যাদার প্রশ্নে সংবিধানে যুক্ত করা হবে যে, “বাংলাদেশ একটি বহু-জাতি, বহু-ধর্মী, বহু-ভাষী ও বহু-সংস্কৃতির দেশ যেখানে সকল সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হইবে।”
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি : রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের েেত্র সংসদের উভয় করে (নিম্নক ও উচ্চক) সদস্যদের গোপন ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন। এেেত্র একটি দলের নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির মতা ও দায়িত্ব : রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মতায় ভারসাম্য আনয়নের ল্েয রাষ্ট্রপতির মতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) সংশোধনীর প্রস্তাব করে কারও পরামর্শ বা সুপারিশ ছাড়াই নিজ এখতিয়ারবলে রাষ্ট্রপতি যেসব পদে নিয়োগ দিতে পারবেন, সেগুলো হলো-(১) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, (২) তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, (৩) বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও সদস্য (৪) আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য, (৫) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, (৬) এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য। তবে ৫ ও ৬ নং ক্রমিকের বিষয় বিএনপিসহ কয়েকটি দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়ার েেত্র বলা হয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। আইনসভার নিম্নকে অভিশংসন প্রস্তাবটি দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে পাস করার পর তা উচ্চকে পাঠানো হবে। উচ্চকে শুনানির মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনে অভিশংসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী : একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর পদে সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকতে পারবেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, যেমন একই সাথে দলীয় প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না-এমন বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হবে। এ বিধানে নোট অব ডিসেন্ট আছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা : সংসদ ভেঙে দেয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ১৫ দিন আগে মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে, ভঙ্গের পরবর্তী ‘১৫’ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে। সংসদের মেয়াদ অবসানের েেত্র এর ৩০ দিন আগে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধিসহ মোট পাঁচ সদস্য সমন্বয়ে একটি কমিটি হবে। এ কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করবেন। কমিটির যেকোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার। কমিটি গঠনের পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল এবং স্বতন্ত্র এমপিদের কাছ থেকে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবেন। এেেত্র প্রতিটি দল একজন এবং স্বতন্ত্র সদস্য একজন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে অনধিক নব্বই দিন। তবে দৈব-দুর্বিপাকজনিত কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরও সর্বোচ্চ ত্রিশ দিন দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
দ্বিকবিশিষ্ট আইনসভা : একটি দ্বিকবিশিষ্ট আইনসভা থাকবে। নিম্নক (জাতীয় সংসদ) এবং উচ্চক (সিনেট) ১০০ (একশত) সদস্য নিয়ে নিয়ে গঠিত হবে। নিম্নকরে নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে উচ্চকরে ১০০ (একশত) জন সদস্য নির্বাচিত হবেন। দলগুলো নিম্নকরে সাধারণ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের সময় উচ্চকরে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। তালিকায় কমপে ১০% নারী প্রার্থী থাকিতে হইবে। এেেত্র নোট ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি।
নির্বাচন ব্যবস্থা : প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত সংখ্যক নির্বাচন কমিশনারগণের সমন্বয়ে বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে। আইনের দ্বারা নিম্নরূপে গঠিত একটি বাছাই কমিটির মাধ্যমে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই করা হবে। (১) জাতীয় সংসদের স্পিকার (যিনি এই বাছাই কমিটির প্রধান হবেন), (২) ডেপুটি স্পিকার (যিনি বিরোধী দল হতে নির্বাচিত হবেন), (৩) প্রধানমন্ত্রী, (৪) বিরোধী দলের নেতা, এবং (৫) প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি হিসেবে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি।
বিচার বিভাগ : প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের বিদ্যমান ব্যবস্থা পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগদান করবেন। এখানে শর্ত দেয়া হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে তবে তারা সংবিধানে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুইজন বিচারপতির মধ্য হতে যেকোনো একজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দান করবেন মর্মে বিধান সংযোজন করতে পারবে। “বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করা হইবে।
সনদের পটভূমিতে বলা হয় প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে বিরুদ্ধে জনগণের দীর্ঘ লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এরপর পূর্ববাংলা তার অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের স্বায়ত্তশাসন এবং ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারের অবসান ঘটে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধিকারের প্রতিফলন ঘটে। এরপর ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা এবং এক রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়; ১৯৭৫ সালে সংবিধান সংশোধন করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একদলীয় বাকশাল গঠন করা হয়। একই বছরে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ১৯৭৬ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিগত পাঁচ দশকে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একদিকে যেমন পুরোপুরি টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। অপর দিকে তেমনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নামমাত্র থাকলেও তা অত্যন্ত ন্যুজ ও দুর্বলভাবে কাজ করেছে। বস্তুতপে রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং মতার অপব্যবহারের অবারিত সুযোগ নিশ্চিতের ল্েয বিগত ১৬ বছরে দলীয় প্রভাবকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর, জবাবদিহিতাবিহীন ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। ২০০৬ সালে কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের প্রেেিত ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। গঠিত হয় একটি অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক। নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। বিগত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার মতাসীন হয়ে ক্রমান্বয়ে অবশিষ্ট গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করতে থাকে। তারা রাজনৈতিক প্রতিপ ও সমালোচকদের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা, হামলার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় হ্রাস ও ভীতির রাজত্ব কায়েম করে। ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সংঘটিত হয় এক নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে বিশেষ ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠী বন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয়। দেড় দশকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে মতাকে কুগিত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পরপর তিনটি বিতর্কিত ও প্রহসনমূলক নির্বাচন করে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের ব্যবস্থা কায়েম করে।
বাস্তবায়ন পদ্ধতিতে ঐকমত্য হয়নি : রোববার ফের বৈঠক
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর চূড়ান্ত কপি পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল বিকেলে ৩৩টি দল ও জোটের কাছে ৩৫ পৃষ্ঠার জুলাই সনদের কপি পাঠানো হয়। একই সাথে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের জন্য প্রত্যেকটি দল ও জোটের পক্ষ থেকে আগামীকাল শনিবারের মধ্যে দু’জনের নাম দেয়ার জন্য বলেছে কমিশন। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গতকাল রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তৃতীয় দফার প্রথম দিন বৈঠক করে কমিশন। বাস্তবায়নের উপায় চূড়ান্তকরণে আগামী রোববার ফের দলগুলোর সাথে বসবে কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের বিভিন্ন সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়। তবে, বাস্তবায়নে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়নি কমিশন। বৈঠক শেষে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ ব্রিফিং করেন। এ সময় কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো: এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো: আইয়ুব মিয়া এবং ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর চূড়ান্ত ভাষ্য আজই পাঠানো হচ্ছে (ইতোমধ্যে হয়েছে)। এ সনদে সবার মতের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। কমিশনের প থেকে সনদে স্বারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর (শনিবার) বিকেল ৫টার মধ্যে দু’জন ব্যক্তির নাম পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে গতকালের আলোচনায় দু’টি বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি জানান, সুপারিশের যেসব বিষয় সংবিধানসংশ্লিষ্ট নয় সেসব বিষয় বাস্তবায়নের জন্যে অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারি করতে পারে এবং সুপারিশের যেসব বিষয় সরকারি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে আদেশ ও বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ বাস্তবায়ন করতে পারে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে প থেকে ইতোমধ্যে অধ্যাদেশ জারি ও যথাযথ পদেেপর মাধ্যমে তা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে গতকালের আলোচনায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-সহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। আগামী রোববার বেলা আড়াইটায় আবারো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনায় বসবে কমিশন।
জুলাই সনদের শেষের দিকে পরিশিষ্টে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের তালিকা দেয়া হয়। দল ও জোটগুলো হলো- আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), আমজনতার দল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, গণ অধিকার পরিষদ (জিওপি), গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণফোরাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, জাকের পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, জাতীয়তাবাতী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, সিপিবি, বাংলাদেশ বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), ভাসানী জনশক্তি পার্টি, লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) এবং ১২ দলীয় জোট।