সংশোধন হয়েছে ‘সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯’। আগামী জানুয়ারি মাস তথা নতুন বছরের শুরু থেকে সংশেধিত ‘সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০২৫’ এর আওতায় কৃষকের কাছে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার বিক্রি কার্যক্রম শুরু হবে। গত মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘সারবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটি’র সভায় এই নীতিমালাটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের) বা বিএডিসির (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) আলাদা করে আর ডিলারশিপ থাকছে না। কৃষি মন্ত্রণালয় দাবি করছে, ডিলার সিন্ডিকেট ভাঙা এবং সুষ্ঠু বণ্টনব্যবস্থা নিশ্চিত করা এ নীতিমালার উদ্দেশ্য। এতে দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা, বিএডিসি ও বিসিআইসির আলাদা ডিলার-ব্যবস্থা বাতিল, ডিলারের সংখ্যা বৃদ্ধি, কারসাজির সাথে জড়িতদের বাদ দেয়া, আমদানি থেকে খুচরা বিক্রি পর্যন্ত নজরদারি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বিতরণব্যবস্থা চালুর মতো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নতুন নীতিমালায় এক ছাতার নিচে আসছে দেশের সামগ্রিক সার ব্যবস্থাপনা।
কমিটির আহ্বায়ক কৃষি ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো: জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এমদাদ উল্লাহ মিয়ানসহ অর্থ, শিল্প, মন্ত্রিপরিষদ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, বিসিআইসি, বিএডিসির প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের প্রশাসকসহ বিভিন্ন দফতরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। নতুন নীতিমালাটি সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০০৯ এর প্রতিস্থাপন হবে।
অনুমোদিত নতুন নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি ইউনিয়নে তিনজন করে ডিলার থাকবেন। ইউনিয়নের প্রতি ওয়ার্ডে (৯টি) একটি করে ডিলারের নিজস্ব সেলস সেন্টার থাকবে। আলাদাভাবে কোনো সার ডিলার বা খুচরা ডিলার থাকবে না। সার ডিলার সরকার নিযুক্ত/সরকারি নিবন্ধনকৃত/সরকারি তালিকাভুক্ত সার ডিলার হিসেবে বিবেচিত হবেন। এ ক্ষেত্রে বিসিআইসি বা বিএডিসি ডিলার নামক কোনো বিভাজন থাকবে না। সব ডিলার সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক যথানিয়মে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার বরাদ্দ পাবেন। প্রতি ইউনিয়নে তিনটি, পৌরসভায় একটি এবং সিটি করপোরেশনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডিলার ইউনিট থাকবে। ডিলার ইউনিটে খালিসাপেক্ষে প্রয়োজনে ডিলার নিয়োগ হবে; সংশ্লিষ্ট উপজেলার ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হবে। সরকারি কর্মচারী বা জনপ্রতিনিধি ডিলার হতে পারবেন না। একই পরিবারের একাধিক ডিলারশিপ থাকতে পারবে না। ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি ডিলার হতে বা থাকতে পারবেন না। সার ডিলার নিয়োগের ক্ষেত্রে একই পরিবারের একজনের ডিলারশিপ থাকলে অপর কেউ আবেদন করতে বা ডিলার থাকতে পারবেন না। ডিলার হিসেবে আবেদনকারীকে পরিবারের সদস্যদের যেমন পিতা, মাতা, পুত্র, অবিবাহিত কন্যা ও নির্ভরশীল ভাই-বোন) তালিকা ও পেশা উল্লেখ করতে হবে। সিটি করপোরেশনের আবেদন সরাসরি জেলা, সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির কাছে করতে হবে। জেলা সার, বীজ ও মনিটরিং কমিটি যাচাই বাছাই পূর্বক অগ্রাধিকার ক্রম প্রস্তুত করে মতামতসহ সার ডিলার সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে পাঠাবে। জেলা থেকে আবেদনকারীদের তথ্য প্রাপ্তি সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতি ইউনিটের বিপরীতে সফল আবেদনকারীর নাম সংশ্লিষ্ট জেলা, সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির কাছে পাঠাবে। জেলা কমিটি ডিলার নিয়োগ চূড়ান্ত করবে। আগে জামানত ছিল যেখানে দুই লাখ টাকা নতুন নীতিমালায় তা চার লাখ টাকা করা হয়েছে।
খসড়া নীতিমালা সূত্রে আরো জানা যায়, নিয়োগপ্রাপ্ত ডিলারদের নিয়োগের পরবর্তী বছর হতে প্রতি বছর ১ জুলাই থেকে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে ডিলারশিপ নবায়নে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক এবং জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতির কাছে আবেদন করতে হবে। নবায়ন ফি এক হাজার টাকা। ১৬ আগস্ট পর্যন্ত বিলম্বের কারণে ৫০০
টাকা বিলম্ব ফিসহ এক হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নবায়নে ব্যর্থ হলে ডিলারশিপ সাময়িক বাতিল হবে। কৃষকের কাছে খুচরা সার বিক্রয়ের জন্য নিয়োজিত ডিলাররা প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে খুচরা সার বিক্রয় কেন্দ্র করতে পারবে। নতুনভাবে পূর্বের পদ্ধতিতে নিয়োজিত খুচরা বিক্রেতাদের এসব বিক্রয় কেন্দ্রে স্থলাভিষিক্ত করা যেতে পারে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে। প্রত্যেক সার ডিলারের অধীন তিনটি করে বিক্রয় কেন্দ্র থাকবে। মূল গুদাম স্থানে একটি ও অপর দু’টি ওয়ার্ডে সুবিধাজনক স্থানে (উপজেলা কৃষি অফিসারের নির্দেশনা অনুযায়ী) বিক্রয় কেন্দ্র হবে। বিক্রয় কেন্দ্রের সামনে সারের নাম, বিক্রয়মূল্য, সরকার কর্তৃক প্রদেয় ভর্তুকির পরিমাণ ইত্যাদি সংবলিত সাইনবোর্ড রাখতে হবে। প্রত্যেক ডিলার সার উত্তোলন রেজিস্টার (বরাদ্দকৃত সারের পরিমাণ ও উত্তোলনকৃত সারের পরিমাণের তথ্য) থাকবে। প্রতি বিক্রয়কেন্দ্রে তা লিপিবদ্ধ থাকবে। নির্ধারিত ক্যাশমেমোর মাধ্যমে সার বিক্রয় হবে। এক উপজেলার বরাদ্দকৃত সার অন্য উপজেলায় হস্তান্তর করা যাবে না। আর্থিক অসচ্ছলতা বা অন্য কোনো কারণে উপজেলা কৃষি অফিসে আবেদনের মাধ্যমে ডিলারশিপ সমর্পণ করা যাবে। ডিলারশিপ একবার সমর্পণ হলে তা আবার চালু করা যাবে না। ডিলারশিপ হস্তান্তর বা মালিকানা পরিবর্তন করা যাবে না। তবে, ডিলারের মৃত্যু/গুরুতর অসুস্থতা/শারীরিকভাবে অক্ষম হলে ডিলারের অবেদনের প্রেক্ষিতে ডিলারশিপের পরফরম্যান্সের ভিত্তিতে সন্তোষজনক হলে জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটি হস্তান্তর করবে। সন্তোষজনক না হলে এই কমিটি নতুন ডিলার নিয়োগ দিতে পারবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সার ডিলার জানান, ডিলারদের জামানত দ্বিগুণ করার বিধান করা হচ্ছে। আবার প্রত্যেক ডিলারকে তিনটি দোকান, গোডাউন পরিচালনা করতে হবে। এর জন্য ব্যয় বাড়বে। কিন্তু সরকার আগের দুই টাকা কমিশন দিয়েই এটা সারতে চাচ্ছে। এতে করে সারা দেশে সার বিক্রিতে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
জানা যায়, বর্তমানে বিসিআইসির পাঁচ হাজার ৬০০ এবং বিএডিসির আওতাধীন পাঁচ হাজার ২০০ ডিলার রয়েছেন। তবে দীর্ঘদিন ধরে ডিলারদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যেগুলো খতিয়ে দেখছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, একই পরিবারের সদস্যদের ৩-৫ জন পর্যন্ত ডিলারশিপের লাইসেন্স পাওয়া গেছে। যাদের একটি রেখে বাকিগুলো বাতিল করা হবে। আবার অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে এমন ডিলারদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী এমনিতেই ডিলারের সংখ্যা বাড়বে। পাশাপাশি যাদের ডিলারশিপ বাতিল করা হবে তাদের জায়গায়ও নতুন ডিলার নিয়োগ দেয়া হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বিসিআইসির ডিলার নিয়োগ করা হয় ১৯৯৫ সালে। সে সময় পাঁচ হাজার ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৯৬-২০০০ সালের মধ্যে আরো প্রায় ৮০০ ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়। আর ২০০৭-০৮ সালে বিএডিসির পাঁচ হাজার ২০০ ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত সেই সময়ের নিয়োগ করা ডিলারদের দিয়েই সারা দেশে সার বিতরণকার্যক্রম চলছে।
জানা গেছে, ‘সারবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটির’ তিনটি সভার মাধ্যমে এই নীতিমালাটি চূড়ান্ত করা হয়েছে, যার একটি সভাতেও বর্তমান ডিলারদের মতামত নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ। সবশেষ গত মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘সারবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটির’ সভায় বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের কিছু সদস্যকে এই সভায় ডাকলেও পরে মিটিং থেকে বের করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এই সভায় শুধু ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সচিব এবং সংগঠনের প্রশাসক উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ডিলারদের খরচ বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে আনা হয়। তখন কমিটির সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন- তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ে কমিশন বাড়ানোর জন্য একটি প্রস্তাবনা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। ডিলারদের কমিশন দ্বিগুণ করতে সরকারের বাড়তি খরচ পড়বে এক হাজার ১৬০ কোটি টাকা। তবে দীর্ঘদিন ধরেই ডিলাররা তাদের কমিশন যৌক্তিক পর্যায়ে নেয়ার দাবি করলেও সরকার এতে সম্মতি দেয়নি।
এদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয় চাচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই ডিলারশিপ নীতিমালার বাস্তবায়ন করতে। এখন এটা বাস্তবায়ন না করতে পারলে রাজনৈতিক সরকার এটা করতে চাইবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় যে সময়টাতে (জানুয়ারি) এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে সেটা দেশের কৃষির সর্বোচ্চ মৌসুমে। আসন্ন বোরো মৌসুমের উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে দেশে সারা বছরের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। এই সময়টাতে সারের ব্যবহারও সবচেয়ে বেশি। মৌসুমের মধ্যে এই নীতিমালার বাস্তবায়ন করতে গেলে- ডিলারশিপ পরিবর্তন, সার সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার বিষয়গুলো ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলেও মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
নতুন নীতিমালা প্রসঙ্গে সম্প্রতি কৃষিসচিব ড. মুহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান নয়া দিগন্তকে জানান, আমরা সমন্বিত একটি নীতিমালা তৈরি করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করব। আমরা সমন্বিত নীতিমালা করে পুরো ডিলার সিস্টেমটাকে কৃষকবান্ধব করার উদ্যোগ নিয়েছি। এমনভাবে করছি যাতে সারের যে অচলাবস্থা, সার ডিলার বা খুচরা বিক্রেতা বলে কোনো কিছু থাকবে না। ডিলার আমাদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। তারা কার মাধ্যমে সার কৃষককে দিলেন বা বিক্রি করলেন সেটা তার ব্যাপার। আমরা ডিলারকেই ধরব। ডিলার-রেটেই কৃষক সার পাবেন।