- আড়াই বছরে কাজের অগ্রগতি মাত্র ৮ শতাংশ
- বিশ্বব্যাংকের ঋণ ৫ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতি না থাকলেও ব্যয় বাড়াতে পিছিয়ে নেই সরকারী কর্মকর্তারা। একই অবস্থা বিদেশী ঋণের প্রকল্পেরও। ঝিমিয়ে চলা অভিযোজন এবং ঝুঁকি হ্রাস (রিভার) প্রকল্পের জন্য স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে খরচ বাড়ছে এক হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের প্রকল্প আড়াই বছরে অগ্রগতি মাত্র ৮ শতাংশ। আর খরচ হয়েছে ৬ শতাংশ। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ হলো পাঁচ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আরো এক বছর সময় বৃদ্ধির আবদার করেছে। পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, যেভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে তাতে এক বছর কেন, ১০ বছব বাড়ালেও প্রকল্পটি শেষ হবে না। নতুন রেট সিডিউলের কারণে প্রতিটি খাতে খরচ বেড়েছে। এতে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় বাড়ছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষাকল্পে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অতিমাত্রায় বন্যাকবলিত জেলার জন-জীবন ও গৃহপালিত পশুর ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকির মাত্রা কমানো। বন্যাকবলিত এলাকার জনগোষ্ঠীর নদীবাহিত ও আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি হ্রাস করা এবং দুর্যোগ প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদানে দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। সারা দেশে ৫২১টি স্কুল কাম আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা। স্কুলের মাঠ নির্মাণ করা। আর্থসামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণ, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদানে দেশের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে চার হাজার ৩২৩ কোটি ৪৭ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০২৩ হতে জুন ২০২৮ পর্যন্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গত ১২ মার্চ ২০২৩ তারিখে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়।
প্রকল্পের কাজগুলো : প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ৫২১ টি, সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সোলার ন্যানোগ্রিক সিস্টেম স্থাপন ১০০টি, গবাদি পশুর আশ্রয়ের জন্য সর্বোচ্চ বন্যা লেভেলে উপরে বিদ্যালয়ে মাঠ নির্মাণ ২৫০টি, আশ্রয়কেন্দ্র সংযোগ সড়ক উন্নয়ন ২৭৫ কিলোমিটার, ব্রিজ/কালভার্ট নির্মাণ ১.৮ কিলোমিটার, কমিউনিটি রাস্তা এবং গ্রোথ সেন্টার উন্নয়ন ১৪০ কিলোমিটার, ঘাট উন্নয়ন ১৫টি, রাস্তায় সৌরবাতি স্থাপন ছয় হাজার ৬০০টি, বজ্রপাত সুরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন এক হাজার ৪০০টি।
ব্যয় বাড়ছে মাঝপথেই : বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তন, এলজিইডির রেট শিডিউল পরিবর্তন, অনুমোদিত ডিপিপির কিছু অঙ্গের ব্যয় ও পরিমাণ হাস বা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। মোট ব্যয় এক হাজার ১৮৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে এখন পাঁচ হাজার ৬১০ কোটি ৪১ লাখ টাকা করা হচ্ছে। যেখানে বিশ^ব্যাংকের প্রকল্প ঋণ পাঁচ হাজার ৩৯২ কোটি চার লাখ টাকা। মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে জানুয়ারি ২০২৩ হতে জুন ২০২৯ পর্যন্ত করা হচ্ছে।
খরচের প্রস্তাবনা : ৫২১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৫২৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ফলে প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় পৌনে সাত কোটি টাকা। ১০০টি সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সোলার ন্যানোগ্রিক সিস্টেম স্থাপন ব্যয় ৪৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। যেখানে প্রতিটি সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন করতে খরচ ৪৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। গবাদি পশুর আশ্রয়ের জন্য সর্বোচ্চ বন্যা লেভেলের উপরে বিদ্যালয়ে মাঠ নির্মাণ ২৫০টিতে ব্যয় হবে ৪০৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। এখানে প্রতিটি মাঠের জন্য ব্যয় এক কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আশ্রয়কেন্দ্র সংযোগ সড়ক উন্নয়ন ২৭৫ কিলোমিটার করতে খরচ ৪৫৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে এক কোটি ৬৫ লাখ টাকা। ব্রিজ/কালভার্ট নির্মাণ ১.৮ কিরোমিটারে খরচ ১৭৬ কোটি ৭১ লাখ টাকা। কমিউনিটি রাস্তা এবং গ্রোথ সেন্টার উন্নয়ন ১৪০ কিলোমিটারের জন্য ব্যয় ২৮২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় দুই কোটি দুই লাখ টাকা। ঘাট উন্নয়ন ১৫টির জন্য ৩৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রতি ঘাটের জন্য ব্যয় দুই কোটি টাকার বেশি। রাস্তায় ছয় হাজার ৬০০টি সৌরবাতি স্থাপন খরচ ৪০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রতি বাতির জন্য ব্যয় ছয় হাজার ১৫০ টাকা। এক হাজার ৪০০টি বজ্রপাত সুরক্ষাব্যবস্থা স্থাপন করতে লাগবে ৮৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। প্রতিটির জন্য ব্যয় হবে ছয় লাখ ১৫ হাজার টাকা।
আড়াই বছরে অগ্রগতি ৮ শতাংশ : ২০২৩ সালের জানুয়ারীতে শুরু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদের এই প্রকল্পে আড়াই বছরে অগ্রগতি মাত্র ৮ শতাংশ। যেখানে টাকা খরচ হয়েছে ২৫৫ কোটি ২৫ লাখ ছয় হাজার টাকা বা ৬ শতাংশ বলে পরিকল্পনা কমিশন থেকে জানা গেছে।
প্রকল্প সংশোধনের কারণ : স্থানীয় সরকার বিভাগ বলছে, মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে বিশ্বব্যাংকের ঋণের পরিমাণ ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। তা নির্ধারিত থাকলেও প্রকল্প ঋণ কমিয়ে ৪৪ কোটি ডলারে পুনর্নির্ধারণ করা হয়। হ্রাসকৃত ঋণের পরিমাণের ৪৪ কোটি ডলারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ডিপিপি সংশোধন করা দরকার হয়েছে। ঋণের পরিমাণ কমে গেলেও মুদ্রা বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বৃত অর্থ দ্বারা অতিরিক্ত কাজ অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রকল্প সংশোধন করা প্রয়োজন হয়েছে। আর অনুমোদিত ডিপিপি এলজিইডির ২০১১ সালের রেট শিডিউল অনুসারে প্রস্তুত করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে ২০২২ সালের রেট শিডিউল কার্যকর হয়েছে। নতুন রেট শিডিউল অনুসারে বায় প্রাক্কলন করা প্রয়োজন।
ভ্যাট ও আইটি প্রদান বা কর্তনের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সংশ্লিষ্ট ব্যয়গুলো সমন্বয় করা প্রয়োজন। ডিপিপিভুক্ত ২৮টি প্যাকেজের পূর্তকাজের মোট মূল্য অপেক্ষা টেন্ডারমূল্য অধিক হওয়ায় বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক ইতোমধ্যে পূর্বানুমোদন দেয়া হয়েছে। অনুমোদনকৃত এই অতিরিক্ত ব্যয় প্রতিফলনের জন্য প্রকল্পটি সংশোধন করা প্রয়োজন। মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে কোণঠাসা অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার অর্থ পরিশোধ করায় মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী টাকা অবমূল্যায়নের কারণে প্রকল্প ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ জন্য বিশ্বব্যাংক কর্তৃক সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধের লক্ষ্যে ডিপিপিতে বিধান রাখার জন্য প্রকল্প সংশোধন আবশ্যক।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, প্রকল্প এলাকায় বাস্তবতার নিরিখে কমিউনিটি রাস্তা এবং বাঁধ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্তকরণ এবং বিশ্বব্যাংকের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘বহুমুখী দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পের অসম্পূর্ণ ২১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণকাজ এই প্রকল্পের আওতায় সম্পন্ন করা প্রয়োজন। প্রকল্পটি বৈদেশিক অর্থায়নপুষ্ট। প্রস্তাবিত ১ম সংশোধনে প্রকল্পের কাজের পরিধি সম্প্রসারণ এবং মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। সংশোধন প্রস্তাবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সম্মতি বা মতামত সংক্রান্ত কোনো প্রমাণিক ডিপিপিতে সংযুক্ত করা হয়নি।