বাংলাদেশের বায়ু দূষণের ৪৫ শতাংশই আসে পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে, বাকি দূষণের জন্য দায়ী অভ্যন্তরীণ উৎস। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে পশ্চিম-উত্তর থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্প ও কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে তৈরি ধোঁয়া, ক্ষতিকর গ্যাসীয় পদার্থ ও ধুলা বাংলাদেশে চলে এসে এখানকার বায়ুকে অস্বাস্থ্যকর করে দিচ্ছে। এর বাইরে দেশের অভ্যন্তরীণ ইটাভাটা, নির্মাণ শিল্প, শিল্প প্রতিষ্ঠান, গৃহস্থালি জ্বালানি থেকে উদ্ভূত ধোঁয়া ও গ্যাসীয় পদার্থ বায়ুকে দূষণ করছে। ২০১৯ সালের বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, বায়ু দূষণের সাথে ফাইন পার্টিকল (পিএম ২.৫) থাকায় তা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফাইন পার্টিকল মানুষের চুলের ৩০ ভাগের এক ভাগ আয়তনের চেয়েও অতি ক্ষুদ্র কণা, যা ২.৫ মাইরেক্রামিটারের সমান বা এর চেয়ে কম। এটা এত ক্ষুদ্র যে ফুসফুসের ছাকনিগুলো আটকাতে পারে না। ফলে এটা খুব সহজেই রক্তে মিশে যেতে পারে এবং স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
এই ফাইন পার্টিকলের কারণে মানুষের উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়, শ্বাসককষ্ট হাঁপানি, দীর্ঘমেয়াদি ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস ও সিওপিডি বাড়ে। এ ছাড়া স্মৃতিশক্তি ও মনোযোগে প্রভাব পড়ে। এমনকি বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে। বাংলাদেশে ইদানীং উল্লেখিত রোগের আক্রান্তের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন। পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ড. জিয়াউল হক নয়া দিগন্তকে জানান, বায়ু দূষণের যে ৪৫ শতাংশ পশ্চিম থেকে আসে তা ইন্দোগেঞ্জেটিক প্লেনে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানার ধোঁয়া ও কৃষিজাত ফসল ঘরে তোলার আগে তা পরিষ্কার করার সময় উদ্ভূত ধুলা বায়ুতে মিশে যায়। এই ধুলা প্রায় সারা বছরই আসে। তবে বেশি আসে অক্টোবর থেকে এপ্রিলের মধ্যে। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শুধু ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসে তাই-ই নয়, এমনকি লাহোরের শিল্প খাতের ধোঁয়া ও কৃষিজাত ধুলাও এর সাথে মিশে যায়। বাংলাদেশ পূর্বে অবস্থিত দেশ বলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের বায়ুমান নিকৃষ্ট পর্যায়ে চলে যায়। মাঝে মধ্যে নিকৃষ্ট বায়ু মানের দিক থেকে ঢাকার বায়ু শীর্ষ অবস্থানে উঠে আসে। ড. জিয়াউল হক আরো জানান, পরিবেশ অধিদফতরের বায়ুমান যন্ত্রে শুধু যে ঢাকার বায়ুু নিকৃষ্ট অবস্থানে উঠে আসে তা নয় রংপুর, ময়মনসিংহের মতো উত্তরাঞ্চলের শহরগুলোও শীর্ষ অবস্থানে উঠে আসে। শুধু মৌসুমে রংপুর শহরের বায়ুমান ঢাকার চেয়ে বেশি নিকৃষ্ট অবস্থানে উঠে আসে।
আন্তঃদেশীয় বায়ু ছাড়াও ঢাকার আশেপাশে গড়ে ওঠা ইটভাটা, শিল্প-কারখানা, নির্মাণ শিল্প, এমনকি রান্নায় কাঠ পোড়ানো থেকে উদ্ভূত ধোঁয়া ও মাটির উপরিস্থিত ধুলা বায়ুকে দূষিত করছে। এর সাথে যোগ হয়ে থাকে বাস-ট্রাক, প্রাইভেট কারের মতো যানবাহনের ধোঁয়া।
সাময়িক সমাধান হিসেবে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে পরিবেশ অধিদফতর অভিযান পরিচালনা করে থাকে। সারা দেশে প্রায় ৮ হাজার ইটভাটা রয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী, শুধুমাত্র ঢাকার সাভার উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে রয়েছে ১০৬টি। এ ছাড়া গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীতে আরো শ’খানেক ইটভাটা আছে। এর বেশির ভাগই অবৈধ। পরিবেশ অধিদফতর ছাড়াও স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ ইটভাটা ভেঙে দিলেও পরে আবার স্থাপন করে ইটের ব্যবসায় গড়ে তোলে পরিবেশ দূষিত করে। যে পদ্ধতিতে ইট পোড়ানো হয় তাতে পরিবেশ দূষিত হলেও আরো পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি রয়েছে সেই পদ্ধতি ব্যবহারের ইট ব্যবসায়ীদের আগ্রহ নেই।
ড. জিয়াউল হক বলেন, বায়ু দূষণের অভ্যন্তরীণ আরেকটি উৎস মানুষের ঘরে ঘরে ব্যবহার করা চুলা। এসব চুলায় কাঠ, বাঁশ, পাতা ও শুকনা গোবর পোড়ানো হয়। তা থেকে যে ধোঁয়া উৎপন্ন হয় সেটাও বায়ু দূষণে বিরাট ভূমিকা রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মানুষ বায়ু দূষণের ফলে অকালে মারা যায়। এর মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও ফুঁসফুসজনিত রোগী বেশি।
বায়ু দূষণ এশিয়ার মতো দেশগুলোর সমস্যা বলে উন্নত দেশগুলো এটা নিয়ে গবেষণা করে না। ফলে এই খাতে দাতাসংস্থার অর্থায়নও কম। এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বসে বায়ু দূষণের সমাধান বের করতে পারলে তা সহজ হতে পারে বলে পরিবেশবিদরা মনে করেন।



