বাংলাদেশের আর্থিক খাত দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণে বিশৃঙ্খলা ও অস্বচ্ছতার শিকার হয়ে আসছে। বহু প্রতিষ্ঠান বিদেশী ঋণ নিয়েছে কোনো অনুমোদন ছাড়াই, যার তথ্য সরকারের কোনো সংস্থার কাছেই নেই। ফলে ঋণ খেলাপি হলেও তাদের শনাক্ত করা যায় না এবং তারা আবার নতুন ঋণ নিতে পারছে। এতে এক দিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, অন্য দিকে ঋণ শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাংকাররা একে “গুপ্ত বৈদেশিক ঋণ” নামে আখ্যা দিয়েছেন। এ সমস্যা নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
নতুন সার্কুলার ও কার্যকর সময় : বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি সার্কুলার জারি করেছে, যা আগামী ১ নভেম্বর ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে। সার্কুলার অনুযায়ী দেশের সব তফসিলি ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, বেসরকারি খাতের সব ধরনের বৈদেশিক ঋণের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোতে (সিআইবি) রিপোর্ট করতে হবে। এর ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি হবে, যা ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতাদের প্রকৃত পরিস্থিতি প্রকাশ করবে।
গুপ্ত ঋণে সঙ্কট : বর্তমানে দেশের বৈদেশিক ঋণের মোট পরিমাণ ১১৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে সরকারি ঋণ তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ, কারণ ঋণ নিতে হলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদন লাগে। কিন্তু বেসরকারি খাতের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের এই ঋণের বড় অংশই অনুমোদন ছাড়া নেয়া হয়েছে, যার তথ্য বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও নেই। ফলে এসব ঋণ খেলাপি হলেও কোনো তালিকায় প্রতিফলিত হয় না। এ অবস্থায় ঋণগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে বা বিদেশে সহজেই নতুন ঋণ নিতে পারছে। ঋণ পরিশোধের সময় হঠাৎ এ ধরনের ঋণ প্রকাশ্যে এলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয় এবং ডলার সঙ্কট দেখা দেয়।
কী কী তথ্য দিতে হবে : বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত ও অনুমোদনবিহীন সব বৈদেশিক ঋণের তথ্য সিআইবিতে দিতে হবে। ঋণের পরিমাণ, গ্রহণের তারিখ, মেয়াদ, পরিশোধ পদ্ধতি ও স্থিতি রিপোর্ট করতে হবে। ঋণ খেলাপি হয়েছে কিনা, মেয়াদোত্তীর্ণ কিনা তা জানাতে হবে। ঋণগ্রহী প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ২০ শতাংশের বেশি শেয়ারধারী এবং জামিদাতার নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিদেশী ঋণদাতার নাম, দেশ, ঠিকানা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য জানাতে হবে। ঋণের তথ্য বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়াও মার্কিন ডলারে রিপোর্ট করতে হবে। কোনো পরিবর্তন ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে সিআইবিকে জানাতে হবে।
গুরুত্ব ও সম্ভাব্য প্রভাব : এ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে দেশের আর্থিক খাতে বহুমুখী ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রথমত. বৈদেশিক ঋণ খাতে স্বচ্ছতা সৃষ্টি হবে এবং ঋণ ঝুঁকি কমবে। দ্বিতীয়ত. ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলো ঋণ অনুমোদনের সময় ঋণগ্রহীতার প্রকৃত সক্ষমতা ও ঝুঁকি যাচাই আরো দক্ষতার সাথে করতে পারবে। তৃতীয়ত, খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের শনাক্ত সহজ হবে, ফলে তারা আর নতুন ঋণ নিতে পারবে না। পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে, কারণ দেশীয় ব্যাংকিং খাতে জবাবদিহিতা ও শৃঙ্খলা স্পষ্ট হবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং উন্নত হওয়ার সম্ভাবনাও সৃষ্টি হবে।
শাস্তির বিধান : বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট করেছে, যদি কোনো ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান মিথ্যা বা অসম্পূর্ণ তথ্য প্রদান করে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য গোপন করে, তবে সিআইবির বিদ্যমান সার্কুলার অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা ও শাস্তি আরোপ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ সংক্রান্ত তথ্য সিআইবিতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে দীর্ঘদিনের অস্বচ্ছতা ও বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটবে। এতে শুধু বৈদেশিক মুদ্রা বাজারই স্থিতিশীল হবে না বরং দেশের আর্থিক খাতে জবাবদিহিতা ও ঋণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। একই সাথে বিদেশী বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার আস্থাও বাড়বে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।