- ১৯৬ প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা ৫১ হাজার কোটি টাকা
- এস আলম একাই হাতিয়ে নিয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা
- বেশির ভাগই নামসর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠান
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ১৯৬টি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা রয়েছে ৫১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিতর্কিত ব্যবসায়ী সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম একাই বেনামী ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের কোনো অর্থই পরিশোধ করা হচ্ছে না। এর ফলে গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে ব্যাংকটি। গত ৩১ মার্চ ২০২৫ ভিত্তিক ব্যাংকটির ইনভেস্টমেন্ট মনিটরিং এন্ড রিকভারি বিভাগের একটি প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপকরা জানিয়েছেন, কোনো গ্রাহকের অর্থই চাহিদা অনুযায়ী পরিশোধ করা যাচ্ছে না। গ্রাহক ভেদে পাঁচ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি পরিশোধ করা হচ্ছে না। এতে গ্রাহকের মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়ে যাচ্ছে। যেভাবে সবাই আমানত নিতে চাপ সৃষ্টি করছে তাতে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে পড়ে যাচ্ছে ব্যাংকটি। গ্রাহকের চাপ সামলাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ব্যাংকটির শাখা ব্যবস্থাপকরা। চাকরি যেন তাদের কাছে এখন বোঝা হয়ে পড়েছে। যারা টাকা নিয়ে পালিয়েছেন তারা টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। আবার গ্রাহকও কেউ টাকা জমা দিচ্ছেন না। শুধু উত্তোলন করতে আসছেন। শাখা ব্যবস্থাপকরা এ অবস্থায় গ্রাহকের চাপ সামলাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠান, ভুয়া দলিল, জামানতকৃত সম্পত্তির অতিমূল্যায়নসহ নানাবিধ অনিয়মের মাধ্যমে নামে বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। বিশাল পরিমাণ ঋণখেলাপি, মূলধন ঘাটতি ও লোকসান নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ব্যাংকটি। আর্থিক খাতের মাফিয়া এস আলম নিয়ন্ত্রিত এ ব্যাংকটিতে দীর্ঘ দিন যাবত চলে এই লুটপাট। ভুয়া দলিল দিয়ে কাগুজে কোম্পানির নামে বিনিয়োগ গ্রহণ করতো এস আলম।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২৫ সালের মার্চ মাসে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা। যার ৫৮ হাজার ১৮২ কোটি টাকা খেলাপি। শতকরা হিসেবে যা মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ।
ব্যাংকটি এ পর্যন্ত আমানত সংগ্রহ করেছে ৪৩ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। মার্চ ২০২৫ প্রতিবেদন অনুযায়ী এ ব্যাংকে প্রায় ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কিছু ব্যাংকে প্রকৃত তথ্য গোপন করে লুটপাট চালানো হতো। ৫ আগস্ট ২০২৪ হাসিনা সরকার পালানোর পরে তথ্যগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। আতঙ্কিত হয়ে গ্রাহকগণ একযোগে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন শুরু করলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দেয়।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান পরিশোধিত মূলধন দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২০৮ কোটি টাকায়। এক সময়কার ইসলামী ধারার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমানত সংগ্রহকারী এই ব্যাংকটির বর্তমান লোকসানের পরিমাণ ৪০৫ কোটি টাকা।
নামে বেনামে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মাফিয়া এস আলম। যথাযথ তথ্য উপাত্ত না থাকায় যা উদ্ধার করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড় বিনিয়োগের কোনোটাতেই মানা হয়নি যথাযথ নিয়মাচার। দলিল জালিয়াতি, বন্ধকিকৃত সম্পত্তির অতিমূল্যায়ন, ভুয়া ইন্সট্রুমেন্টের বিপরীতে বিনিয়োগ প্রদান, ইসলামী ব্যাংকিং শরিয়াহ পরিপালন না করে বিনিয়োগ প্রদানসহ দেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘ সময় ধরে নানা ধরনের অনিয়ম চলেছে। এসময় ব্যাংকের পরিচালকরা এক ধরনের অলিখিত চুক্তির মাধ্যমে একে অপরকে বিনিয়োগ সুবিধা দিতো এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সেটা পরিশোধ করতো না।
দেশবন্ধু গ্রুপ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গুলশান শাখার বিনিয়োগ গ্রহীতা, যার খেলাপি ঋণের বর্তমান স্থিতি এক হাজার ১৬৮ কোটি টাকা। গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু সুগার মিলস লি., দেশবন্ধু ফুড এন্ড বেভারেজ লি., দেশবন্ধু টেক্সটাইল মিলস, সাউথইস্ট সোয়েটার্স লি. এবং এম. আর. ট্রেডিং-এর নামে বিনিয়োগগুলো বিতরণ করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত না দেয়ায় বর্তমানে তা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আরেক বিনিয়োগ গ্রহীতা সিকদার গ্রুপ যার অনাদায়ী বিনিয়োগের স্থিতি ৮১০ কোটি টাকা। সিকদার গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান মৃত জয়নুল হক সিকদারের ছেলে রন হক সিকদার, রিক হক সিকদার ও দীপু হক সিকদারের স্বত্বাধিকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এ বিনিয়োগগুলো বিতরণ করা হয়েছে। বিনিয়োগ নিয়ে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কোনো টাকা ফেরত না দেয়ায় এগুলোও খেলাপিঋণে পরিণত হয়।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য কিছু ঋণখেলাপি গ্রাহক- এমআরসি বিজনেস হাউজ ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের জুবিলি রোড শাখার বিনিয়োগগ্রহীতা (স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ রাসেল চৌধুরী) যার খেলাপিঋণের পরিমাণ ৮৭৫ কোটি টাকা, গ্লোব ট্রেডার্স (স্বত্বাধিকারী মো: জহির উদ্দিন) জুবিলি রোড শাখার বিনিয়োগগ্রাহক যার বর্তমান স্থিতি ৮০২ কোটি টাকা, তাসনিম ফ্লোউর মিলস (স্বত্বাধিকারী জহির আহমেদ) আগ্রাবাদ শাখার বিনিয়োগগ্রহীতা যার খেলাপিঋণের বর্তমান স্থিতি ৭২৫.২৫ কোটি টাকা, আগ্রাবাদ শাখার বিনিয়োগগ্রহীতা মো: নুরুন্নবী যার খেলাপিঋণের বর্তমান স্থিতি ৬৫৪ কোটি টাকা, মেসার্স সাফরান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (স্বত্বাধিকারী মাহফুজুল ইসলাম) জুবিলি রোডের বিনিয়োগগ্রহীতা যার খেলাপিঋণের বর্তমান স্থিতি ৬৩৪ কোটি টাকা, লিজেন্ডারি ইন্টারন্যাশনাল (স্বত্বাধিকারী সৈয়দ মারুফ হাসান) খেলাপিঋণের বর্তমান স্থিতি ৬৩৩ কোটি টাকা, এস.এ অয়েল রিফাইনারি লি. (স্বত্বাধিকারী সাহাবুদ্দিন আলম) আগ্রাবাদ শাখার এই বিনিয়োগগ্রহীতার বর্তমান স্থিতি ৬৩২.৬৮ কোটি টাকা, ইমেজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (স্বত্বাধিকারী মো: জাহেদ চৈাধুরী) জুবিলি রোড শাখার বিনিয়োগগ্রহীতা যার বর্তমান স্থিতি ৫৯৮.৪০ কোটি টাকা, রংধনু বিল্ডার্স প্রাইভেট লি. বসুন্ধরা শাখার এই বিনিয়োগ হিসাবের বর্তমান খেলাপি স্থিতি ৫৮৭ কোটি টাকা, ইকো ট্রেড কর্নার (স্বত্বাধিকারী মো: আলমগীর) জুবিলি রোড শাখার বিনিয়োগ হিসাবের বর্তমান খেলাপিঋণের পরিমাণ ৫৭৮ কোটি টাকা, এনেক্স বিজনেস কর্নার (স্বত্বাধিকারী আনোয়ারুল আজম) আন্দরকিল্লা শাখার বিনিয়োগগ্রহীতা যার খেলাপিঋণের বর্তমান স্থিতি ৫৬৫ কোটি টাকা।
৩১ মার্চ ২০২৫ ভিত্তিক ব্যাংকটির ইনভেস্টমেন্ট মনিটরিং এন্ড রিকভারি বিভাগের একটি প্রতিবেদনে ১৯৬টি ঋণখেলাপি গ্রাহকের তথ্য পাওয়া গেছে যার মোট স্থিতি ৫১ হাজার ২৫ কোটি টাকা। এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটির অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও অধিকাংশই নামসর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এস আলম প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। মূলত এই নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করেই ব্যাংকটিকে লোপাট করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট বিনিয়োগের ৯৮ শতাংশ শুধুমাত্র চট্টগ্রাম আর ঢাকায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। বাকি দুই শতাংশ সারা দেশের শাখাগুলোর মাধ্যেমে বিতরণ করা হয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ের শাখাগুলোতে আমানত সংগ্রহ করলেও সেখানে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হতো না। সংগ্রহকৃত আমানত ঢাকা ও চট্টগ্রামের ভুয়া প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের মাধ্যমে হাতিয়ে নিতো লুটেরা এস আলম।
এভাবে এক সময়ের শক্তিশালী ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংককে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়া হয়। ব্যাংকটি এখন গ্রাহকের আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। জনপ্রিয় এই ব্যাংকটি এখন গ্রাহকের হতাশার কারণ হয়ে দঁাঁড়িয়েছে।