গণভোট অধ্যাদেশ অনুমোদন

জন ক্ষমতায়ন নাকি নিয়ন্ত্রিত বৈধতার খোঁজ

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল  : পিআইডি
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল : পিআইডি

গণভোট অধ্যাদেশে ৪টি বড় প্রস্তাব

১ নতুন কাঠামোয় নির্বাচনকালীন সরকার,নির্বাচন কমিশন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠন

২ সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা এবং ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষ গঠন

৩ জুলাই সনদের ৩০ দফা সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর বাধ্যবাধকতা

৪ ভবিষ্যতে অন্যান্য সংস্কার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়নের রোডম্যাপ

‘গণভোট অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করল দেশ। অন্তর্বর্তী সরকার বলছে- এটি হবে জনগণের সম্মতির মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, এটি একই সাথে হতে পারে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসে একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষা।

গতকাল মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এই অধ্যাদেশের অনুমোদন দেয়া হয়। বৈঠকের পর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ দিন। জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত সংস্কার বিষয়ে জনগণের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ মতামত জানার জন্য গণভোটের পূর্ণাঙ্গ আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে।” এ ছাড়া তিনি জানান, ভোটারদের সুবিধার্থে গণভোটের ব্যালট হবে ভিন্ন রঙের। আমরা আশা করছি, আজ বা কালকের মধ্যে গেজেট প্রকাশ করা হবে।

কিন্তু পর্যবেক্ষক মহলে প্রশ্ন উঠছে- এই গণভোট কি শুধুই ‘মতামত নেয়া’, নাকি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রকাঠামো নির্ধারণের বাস্তব ক্ষমতা এতে নিহিত?

ব্রিফিংয়ে আসিফ নজরুল বলেন, গণভোটে প্রশ্ন থাকবে একটি। হ্যাঁ অথবা না ভোট দিতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের ভোটের সময় হবে গণভোট। গণভোটের ব্যালট জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট থেকে পৃথক রঙের হবে। যাতে কেউ দ্বিধার মধ্যে না পড়েন। সংসদ নির্বাচনের জন্য যেসব রিটার্নিং, সহকারী রিটার্নিং, প্রিজাইডিং অফিসার বা পোলিং অফিসার নিয়োগ করা হবে ওনারাই গণভোটের একই দায়িত্ব পালন করবেন। তিনি আরো জানান, পোস্টাল ব্যালটের সুবিধা চালু হওয়ায় বিশেষ পেশা বা কারণে যারা সশরীরে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হতে পারবেন না, তারাও তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে সক্ষম হবেন।

গণভোট নিয়ে সরকার তিন মাস ধরে ব্যাপক প্রচার চালানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল জানান, নির্বাচন কমিশন (ইসি), সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সম্মিলিতভাবে এই প্রচার কার্যক্রমে অংশ নেবে। এই প্রচারের লক্ষ্য হলো গণভোটের প্রক্রিয়া, গুরুত্ব এবং পোস্টাল ব্যালট ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবগত করা।

এর আগে ১৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়নের উপায়সহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তার ওই ভাষণের আগে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদন করা হয়। পরে রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন এ আদেশ জারি করেন। তাতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট একই দিনে করার কথা জানানো হয়। এর মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ আইনি ভিত্তি পায়।

কী আছে এই গণভোট অধ্যাদেশে : অধ্যাদেশ অনুযায়ী ভোটারদের সামনে থাকবে একটিমাত্র প্রশ্ন। কিন্তু সেই প্রশ্নের ভেতরে যুক্ত করা হয়েছে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো বদলে দেয়ার চারটি বড় প্রস্তাব : নতুন কাঠামোয় নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠন; সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা এবং ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষ গঠন; জুলাই সনদের ৩০ দফা সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর বাধ্যবাধকতা; ভবিষ্যতে অন্যান্য সংস্কার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়নের রোডম্যাপ।

অবশ্য কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, একটি মাত্র ‘হ্যাঁ-না’ বাক্সে এতগুলো মৌলিক সিদ্ধান্ত জুড়ে দেয়া ভোটারের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করতে পারে।

একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট : এ বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে এটি প্রশাসনিক সুবিধা, না রাজনৈতিক কৌশল। সরকার জানিয়েছে, সংসদ নির্বাচনের একই কেন্দ্র, একই ভোটার তালিকা এবং আলাদা রঙের ব্যালট পেপার ব্যবহার হবে। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা- সবাই একই থাকবেন। সরকারপক্ষের যুক্তি হলো এতে খরচ কমবে এবং প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়বে।

কিন্তু নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের প্রশ্ন হলো- একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে ভোটার বিভ্রান্তি বাড়বে কি না। প্রশাসনের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফলাফল ব্যবস্থাপনাকে ঝুঁকিপূর্ণ করবে কি না। আর সরকার কি একসাথে দুই ধরনের ফলাফলের রাজনৈতিক চাপ সামাল দিতে পারবে কি না।

ফলাফল কি বাধ্যতামূলক, নাকি পরামর্শমূলক : এই প্রশ্নে সাংবিধানিক অস্পষ্টতা রয়েছে। অধ্যাদেশে বলা হয়নি- ‘হ্যাঁ’ জিতলে সরকার বাধ্য থাকবে কি না আর ‘না’ জিতলে সংসদের ক্ষমতা কী হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি গণভোটকে একটি নৈতিক বৈধতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করেছে- কিন্তু আইনি স্পষ্টতা এখনো অনুপস্থিত।

সন্দেহের জায়গাগুলো কোথায় : বহু বিষয়কে একটি প্রশ্নে ঢোকানো; উচ্চকক্ষ ও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের মতো জটিল বিষয়; ভোটকেন্দ্রে ফল বাতিল বা সীমিত পুনর্ভোটের ক্ষমতা এবং পোস্টাল ব্যালট- যার অপব্যবহারের ইতিহাস আছে। এসব কারণে অধ্যাদেশকে কেউ কেউ বলছেন ‘নিয়ন্ত্রিত গণভোট কাঠামো’ও হয়ে যেতে পারে।

রাজনৈতিক বাস্তবতা : সরকার দাবি করছে জুলাই সনদে স্বাক্ষরকারী দলগুলো ৩০টি প্রস্তাবে সম্মত। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো কিছু দল নির্বাচন আগে গণভোট চায়; কিছু দল একই দিনে। আবার বাম জোটের অংশ এটিকে অসাংবিধানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলছে।

শেষ পর্যন্ত গণভোট অধ্যাদেশ এক দিকে হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক পরীক্ষা, অন্য দিকে এটি নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রাজনৈতিক বৈধতা তৈরির কৌশল- এমন আশঙ্কাও করেন কেউ কেউ। একটি প্রশ্ন এখন সামনে- এই গণভোট কি জনগণকে ক্ষমতার কেন্দ্রে আনবে, নাকি কেবল একটি উচ্চঝুঁকির রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করবে?

গণভোট রঙিন ব্যালটে, সংসদের ব্যালট সাদা : ইসি সচিব

আসন্ন সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একদিনে অনুষ্ঠিত হলেও গণভোটের ব্যালট পেপার রঙিন হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব আখতার আহমেদ। তিনি বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট উভয় ক্ষেত্রে পোস্টাল ব্যালট থাকবে। জাতীয় নির্বাচনের ব্যালট হবে সাদা কাগজের ওপর কালো প্রতীক। আর গণভোটের ব্যালট হবে রঙিন কাগজের ওপর দৃশ্যমান যেকোনো কালি।

ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান।

আখতার আহমেদ বলেন, আগামী ডিসেম্বরের ৫ তারিখের মধ্যে ভোটার তালিকা কমপ্লিট হয়ে যাবে। ৫ তারিখের আগেই যে ভোটার তালিকা পাব সেই তালিকা অনুযায়ী নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাব। আর অন্যান্য যে দ্রব্যাদি যেমন- আমাদের লোগো, ব্যালট বক্স, আঙুলের অমোচনীয় কালি, স্টাম্পপ্যাড এগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ আছে। তিনি বলেন, শেষ যে স্টক আমরা পেয়েছি, সেটাও এখন আমাদের দখলে আছে। আমরা এটা ক্রমাগতভাবে আস্তে আস্তে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেবো, যাতে শেষের দিকে চাপ না পড়ে। তিনি বলেন, প্রথাগতভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সাদা পৃষ্ঠার ওপরে কালো প্রিন্টের ব্যালট পেপার হয়। এ ক্ষেত্রে আমরা একটা রঙিন কাগজ ব্যবহার করব গণভোটের জন্য। রঙিন কাগজের ওপরে যেটা দৃশ্যমান হয় কালো যদি দৃশ্যমান হয়, সেই দৃশ্যমানতা অনুযায়ী আমরা ব্যালট পেপারটা করব।

ইসি মক ভোটিং করবে শনিবার

আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সে উপলক্ষে আগামী ২৯ নভেম্বর শনিবার গণভোট ও সংসদ নির্বাচনের ‘মক ভোটিং’-এর আয়োজন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসির জনসংযোগ পরিচালক রুহুল আমিন মল্লিক এ তথ্য জানিয়েছেন।

ইসির জনসংযোগ প্রধান বলেন, আগামী ২৯ নভেম্বর সব ধরনের ভোটারদের নিয়ে শেরেবাংলা নগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মক ভোটিং অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ইসি।