- ব্যাংকক রুটে ডানা মেলে মাঝপথ থেকেই ফেরা
- বহর থেকে সরানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বহরে থাকা আধুনিক প্রজন্মের উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৩৭-৮০০ দিয়ে অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই ফ্লাইট চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই উড়োজাহাজটি ছয় মাস বিমানের হ্যাংগারেই পড়েছিল। দীর্ঘদিন মেরামতের পর জোড়াতালি দিয়ে ব্যাংকক রুটে ফ্লাইট চালানোর দিনই আবারো বাদ সাধে যান্ত্রিক ত্রুটি। তা-ও আবার মধ্য আকাশে। উড়োজাহাজের ত্রুটি আঁচ করতে পেরে অভিজ্ঞ পাইলট গন্তব্যে না গিয়ে মাঝপথ থেকেই ফ্লাইট ঘুরিয়ে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এতে অল্পের জন্য রক্ষা পান পাইলট, কেবিন ক্রুসহ ওই ফ্লাইটে থাকা যাত্রীদের জীবন।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলছেন, জোড়াতালি দিয়ে ফ্লাইট চালানোর পর আল্লাহ না করুক যদি বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায়, তখন তাদের (কর্তৃপক্ষ) কি করার থাকবে? বড় জোর তদন্ত কমিটি করবে, ক্ষতিপূরণ দেবে, কিন্তু জীবন কি আর তারা ফিরিয়ে দিতে পারবে?
গত ৬ আগস্ট বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে ১৪৬ জন যাত্রী নিয়ে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে বিমানের (বোয়িং-৭৩৭-৮০০) ফ্লাইটটি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করে। প্রায় ৩৫ মিনিট উড়ার পর হঠাৎ বিমানে ঝাঁকুনি অনুভূত হতে শুরু করে। পাইলট ও কো-পাইলট বিষয়টি টের পেয়ে কালবিলম্ব না করে ঢাকার কন্ট্রোল টাওয়ারে যোগাযোগ করে ফেরত আসার কথা জানান। এরপর বেলা ১টা ১৫ মিনিটে ব্যাংককগামী ফ্লাইটটি ঢাকায় নিরাপদেই অবতরণ করে। যাত্রীদের নামিয়ে উড়োজাহাজটির ত্রুটি সারাতে পাঠানো হয় বিমানের নিজস্ব হ্যাংগারে। ওই ফ্লাইটের ১৪৬ যাত্রীকে ৬ ঘণ্টা পর অবশ্য বিমানের অপর একটি ফ্লাইটে ব্যাংককে পাঠানোর ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিমানের এই ফ্লাইট টেকনিক্যাল হওয়ার পর প্রকৌশল বিভাগ থেকে বিমান কর্তৃপক্ষকে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোয়িং-৭৩৭-৮০০ এয়ারক্রাফটটি বিমানের হ্যাংগারে এতদিন সি-চেকে ছিল। ৬ আগস্ট ব্যাংকক রুটে ফ্লাইট যাওয়ার আগের দিন এই উড়োজাহাজটি দিয়ে ঢাকা-সিলেট-ঢাকা রুটে ফ্লাইট চালানো হয়। সেই ফ্লাইটেও প্রেসারাইজেশনের সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ফ্লাইট ফিরে আসার পর প্রকৌশলীরা সেদিনও জানিয়েছিল, প্রেসারাইজেশনের যে সমস্যা ছিল সেটি টেকঅফ করা হয়েছে। প্রকৌশলীদের পক্ষ থেকে এমন কথা (প্রতিবেদন) বলার পরই বিমান কর্তৃপক্ষ ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা রুটে ফ্লাইট চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যাংকক রুটে ফ্লাইট উড়ার আধঘণ্টা পরই আবারো (বোয়িং-৭৩৭-৮০০) ফ্লাইটে একই সমস্যা দেখা দেয়। ওই ফ্লাইটে ১৪৬ জন যাত্রী ছিলেন উল্লেখ করে বলা হয়, উড়োজাহাজের বডিতে কম্পন ছিল। বাধ্য হয়ে ক্যাপ্টেন যাত্রীদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে ব্যাংকক না গিয়ে ঢাকায় ল্যান্ড ব্যাক করেন।
এই উড়োজাহাজের সাথে অনেকটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত এমন একাধিক ব্যক্তি পরিচয় গোপন রাখার শর্তে গত সপ্তাহে নয়া দিগন্তকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা জানি এই এয়ারক্রাফটের অবস্থা খুবই বিপজ্জনক। বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটার আগে কিছু একটা করা উচিত। আপনারা এ বিষয়ে আমাদের কর্তৃপক্ষকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, ৬ আগস্ট অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে এই এয়ারক্রাফট ব্যাংককে পাঠায়। এর পরের দিন কোথায় যেন পাঠানোর কথা ছিল। প্রথম দিন জাহাজ নিয়ে টেকনিক্যাল হয়েছে। পরে আবার ব্যাক করছে। ৭ তারিখের ফ্লাইট প্ল্যানের শিডিউলে দেখেন, এএফএল (লিমা, বোয়িং-৭৩৭-৮০০) মেইনটেন্যান্সে বসছে। তারা বলেন, এই এয়ারক্রাফটা ছয় মাস ধরেই হ্যাংগারে গ্রাউন্ডেড ছিল। এটিকে ৬ মাস চেষ্টা চালিয়ে নানা টেস্ট করে বিভিন্নভাবে আকাশে উড়িয়েছিল। কিন্তু ওটা আর ফ্লাইট সম্পন্ন করতে পারেনি। আবার মেইনটেন্যান্সে আসছে, কবে আবার উঠাবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। চিন্তা করেন, এভাবে কি ফ্লাইট করা যায়? জোড়াতালি দিয়ে জাহাজগুলারে ওপরে উঠাচ্ছে। ফ্লাইটের জন্য পাঠাচ্ছে। ভেরি স্যাড। কখন যে আপনারা শুনবেন একটা দুর্ঘটনা, এটা মানে একবারে মনে হচ্ছে এখন মনে হয় বার্নিং ইস্যু হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা মাফ করুক সবাইকে। যেকোনো সময় একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবেই নির্লজ্জ এসব মেইনটেন্যান্সের লোকজন আর মানেজমেন্টের লোকজনের কারণে।
গতকাল সন্ধ্যার আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. সাফিকুর রহমানের সাথে এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে তার অফিসিয়াল মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি টেলিফোন রিসিভ করেননি।
গত রাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাথে সম্পৃক্ত একাধিক অ্যাভিয়েশন এক্সপার্টের সাথে যোগাযোগ করলে তারা নয়া দিগন্তকে বলেন, বিমানের বহরে মোট ৬টি ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ ছিল। কিছুদিন আগে লিজের দু’টি এয়ারক্রাফট ফেরত দেয়া হয়েছে। বাকি ৪টি বোয়িং-৭৩৭ থেকে দু’টি দিয়ে ফ্লাইট চলছে সুন্দরভাবে। বাকি দু’টি (এএফএল, লিমা এবং এএফএম মাইক) এখন আকাশে উঠা মানেই রিস্ক। এই দু’টি এয়ারক্রাফট বিমানের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মুহূর্তে বিমান কর্তৃপক্ষের করণীয় কি হতে পারে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তাদের বক্তব্য একটাই, বিমানের বহর থেকে এই দু’টি এয়ারক্রাফট ফেস আউট করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আগে যাত্রীদের নিরাপত্তা, তারপর ফ্লাইট। তাদের মতে, এই দু’টি এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট চালালে ওই ফ্লাইটের সাথে যারা ইনক্লুসিভ থাকে তারা সবাই আতঙ্কে থাকে। তাই যেখানে আতঙ্ক থাকে সেখানে বিমানের ফ্লাইট উড়ানোর কোনো দরকার নাই।
উল্লেখ্য, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ এই দু’টি এয়ারক্রাফট প্রথমে লিজে এনে ফ্লাইট চালানো শুরু করে। একপর্যায়ে সমস্যা দেখা দেয়ার পর কর্তৃপক্ষ এই দু’টি এয়ারক্রাফট ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু উড়োজাহাজ লিজ কোম্পানির শর্ত হচ্ছে, যেভাবে উড়োজাহাজ লিজ নেয়া হয়েছিল, সেভাবেই সেটি ফেরত দিতে হবে, যা কোনোদিনও সম্ভব নয়। পরে বাধ্য হয়ে বিমান কর্তৃপক্ষ একযুগের বেশি সময় ফ্লাইট চালানোর পর দু’টি এয়ারক্রাফট কিনে নেয়।