৩১ হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতির পরও অবাস্তব পরিকল্পনা

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ওপর অসন্তুষ্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক

অগ্রণী, জনতা, বেসিক এবং রূপালী ব্যাংক ২০২৯ সালের মধ্যে মূলধন ঘাটতি কমানোর যে পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে, তা ‘অবাস্তব, তথ্য-উপাত্তবিবর্জিত এবং বাস্তবতা-বহির্ভূত’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের মতে, বিপুল মূলধন ঘাটতি, উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ, অপ্রতুল মুনাফা এবং আর্থিক কাঠামোর দুর্বলতায় ভুগতে থাকা এসব ব্যাংকের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অর্জনযোগ্য নয়।

আশরাফুল ইসলাম
Printed Edition

রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক- অগ্রণী, জনতা, বেসিক এবং রূপালী ব্যাংক ২০২৯ সালের মধ্যে মূলধন ঘাটতি কমানোর যে পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে, তা ‘অবাস্তব, তথ্য-উপাত্তবিবর্জিত এবং বাস্তবতা-বহির্ভূত’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের মতে, বিপুল মূলধন ঘাটতি, উচ্চমাত্রার খেলাপি ঋণ, অপ্রতুল মুনাফা এবং আর্থিক কাঠামোর দুর্বলতায় ভুগতে থাকা এসব ব্যাংকের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা অর্জনযোগ্য নয়।

২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছিল ২০২৯ সালের মধ্যে সব ব্যাংককে ঘাটতি কাটিয়ে মূলধন পর্যাপ্ততার আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে। কিন্তু অগ্রণী, জনতা ও বেসিক ব্যাংকের পরিকল্পনা লক্ষ্য অর্জনের বদলে আর্থিক অবস্থার সাথে অসঙ্গতি তৈরি করেছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তুলনামূলক বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা দিয়েছে কেবল রূপালী ব্যাংক। অন্য দিকে ‘প্রভিশন ফরবিয়ারেন্স’ সুবিধার কারণে সোনালী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক কাগজে-কলমে মূলধন উদ্বৃত্ত দেখাতে সক্ষম হয়েছে।

জনতা ব্যাংকের ঘাটতি কমার বদলে বাড়বে : জনতা ব্যাংকের পরিকল্পনা উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র। বর্তমানে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ১০ হাজার ৭০০ কোটি কিন্তু প্রস্তাব অনুযায়ী ২০২৯ সালে তা বেড়ে হবে ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ তারা মূলধন ঘাটতি কমানোর পরিবর্তে বাড়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে। একইভাবে প্রভিশন ঘাটতি এখন ৪৭ হাজার ৩০০ কোটি, যা নামবে ৩০ হাজার ২৪০ কোটিতে। এই লক্ষ্যও বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যহীন। কারণ ব্যাংকটি ২০২৪ সালে করেছে তিন হাজার ৭১ কোটি টাকা লোকসান, আর ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই আরো তিন হাজার কোটি।

অগ্রণীর পরিকল্পনা : পরিকল্পনায় অগ্রণী ব্যাংক জানিয়েছে, আগামী পাঁচ বছরে তারা ৬ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি কমাবে। কিন্তু ব্যাংকটির সাম্প্রতিক আর্থিক অবস্থার সাথে এটি মেলানো কঠিন। ২০২৪ সালেই অগ্রণী ব্যাংক করেছে ৯৩৭ কোটি টাকা লোকসান। ২০২২-২৪ তিন বছরের মধ্যে মাত্র এক বছর ব্যাংকটি নেট লাভে ছিল- সেটিও খুব সীমিত পরিমাণে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে অগ্রণীর বাধ্যতামূলক মূলধন প্রয়োজন ছিল ৯ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা; কিন্তু হাতে আছে মাত্র এক হাজার ৭৫২ কোটি। ফলে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৬৯২ কোটি। অথচ ২০২৫ সালেই ঘাটতি কমবে তিন হাজার ১৪০ কোটি, এ দাবি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে ‘অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী এবং বাস্তবতা-বিবর্জিত’।

অগ্রণীর প্রভিশন ঘাটতি আরো বেশি, ১২ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২৮ সালের মধ্যে তা নেমে আসবে এক হাজার ২৬৭ কোটিতে এবং ২০২৯ সালে হবে শূন্য। খারাপ ঋণের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা অত্যন্ত কম বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বেসিক ব্যাংক : বেসিক ব্যাংকও একইভাবে উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্য দিয়েছে। ব্যাংকটির বর্তমান মূলধন ঘাটতি আট হাজার ৬২১ কোটি টাকা। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২৯ সালে ঘাটতি দাঁড়াবে তিন হাজার ২৫৭ কোটি। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ঘাটতি কমবে পাঁচ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। অথচ পরপর তিন বছর ব্যাংকটি লোকসান ২০২২ সালে ১৩০ কোটি, ২০২৩ সালে ৪১৬ কোটি এবং ২০২৪ সালে ৮৬৩ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেও লোকসান হয়েছে ৫৭৭ কোটি।

ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা এ বিষয়ে জানিয়েছেন, গণমাধ্যমে সঙ্কট সংক্রান্ত খবর প্রকাশের পর ২০২৪ সালে আমানত কমে গেলেও নতুন পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেয়ার পর গ্রাহক আস্থা ফিরছে এবং আমানত পুনরুদ্ধার হচ্ছে। তবে লোকসান প্রবণতার প্রেক্ষাপটে হাজার কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি কমানোর পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত- সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

রূপালী ব্যাংক : রূপালী ব্যাংকের বর্তমান মূলধন ঘাটতি তিন হাজার ৯৭০ কোটি, এবং ব্যাংকটি ২০২৯ সালে তা কমিয়ে দুই হাজার ৯৯১ কোটি টাকায় নামাতে চায়। প্রভিশন ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যও তুলনামূলকভাবে সংযত। গত তিন বছরে ব্যাংকটি ৮৩ কোটি টাকা লাভ করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক রূপালীর পরিকল্পনাকে ‘বাস্তবসম্মত’ বলে বিবেচনা করছে।

অন্য দিকে সোনালী ব্যাংক ও বিডিবিএল বর্তমানে মূলধন উদ্বৃত্ত দেখাচ্ছে। সোনালী ব্যাংক আগামী পাঁচ বছরে উদ্বৃত্ত বাড়িয়ে পাঁচ হাজার ৮৪২ কোটি টাকায় নেয়ার পরিকল্পনা দিয়েছে। বিডিবিএল বর্তমান ১০৩ কোটি উদ্বৃত্ত বাড়িয়ে ৩৯৭ কোটি করার লক্ষ্য জানিয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সমস্যা শুধুই কম মুনাফা নয়, বরং গভীর কাঠামোগত দুর্বলতা। মূলধন ঘাটতি কাটাতে হলে প্রয়োজন খেলাপি ঋণ আদায়ে বিশেষ পুনরুদ্ধার টিম গঠন করা। অনিষ্পন্ন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি ও জামানত জব্দ-বিক্রি করা। একইসাথে ‘ওয়ান-টাইম সেটেলমেন্ট’, অকার্যকর শাখা বন্ধ, ডিজিটাল চ্যানেলে জোর দেয়ার পাশাপাশি পরিচালন ব্যয় কমানো জরুরি।

প্রসঙ্গত, ২০২৫ সালের জুন শেষে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মোট মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি, যা মার্চের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। দেশের ৬১ ব্যাংকের মধ্যে ২৪টি ব্যাংক ন্যূনতম মূলধন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে, যার মধ্যে চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, দু’টি বিশেষায়িত ব্যাংক এবং ১৮টি বেসরকারি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বড় ঝুঁকির মুখে পড়বে।