দেশের আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা এবার চরম সঙ্কটে পড়েছেন। মৌসুমের শেষে আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে পড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অতিরিক্ত উৎপাদন, দুর্বল বিপণন ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের ক্রয় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে গাফেলতির কারণে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছর ৪.৬৭ লাখ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৫.২৪ লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় ১.৩ কোটি টন আলু উৎপাদন হয়েছে, যা দেশের বার্ষিক চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। অথচ দেশে আলুর মোট চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন। এই অতিরিক্ত উৎপাদনই মূলত বাজারে মূল্য পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
তথ্যে দেখা যায়, বগুরা, জয়পুরহাট, রংপুরসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকেরা আলুর দাম নিয়ে দিশেহারা। বগুরার নন্দীগ্রামের কৃষক আব্দুল হালিম বলেন, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে তার যে খরচ হয়েছে তার তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এই লোকসান থেকে উঠে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব।
তিনি জানান, চলতি বছর ২৬ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ক্ষতি গুনতে হয়েছে। জুনে বিক্রি করলে কিছুটা লাভ হতো, কিন্তু সরকার আলু কেনার ঘোষণা দেয়ায় অনেকেই বিক্রি বন্ধ রাখে। শেষে দেখা গেল, কেউ কিনল না, দামও ধসে পড়ল। আব্দুল হালিমের ভাষায়, সরকার বলেছিল আলু কিনবে, কিন্তু এক বস্তাও কেনেনি। আমরা ভেবেছিলাম সরকার কিনবে, তাই কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু তুলি নাই। এখন লোকসানে ডুবে আছি।
তথ্যে দেখা যায় দেশজুড়ে ৩৪০টি কোল্ড স্টোরেজে এখনো প্রায় ২০ লাখ টন আলু মজুত রয়েছে, যার মধ্যে ১১ লাখ টন সবজি আলু এবং ৯ লাখ টন বীজ আলু। কিন্তু দাম এতটাই কম যে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা কোল্ড স্টোরেজে থেকে আলু তোলাই বন্ধ রেখেছেন।
বগুড়ার খন্দকার সিড কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন সাজু বলেন, একজন ব্যবসায়ী ২০ লাখ টাকার আলু রেখেছিলেন, এখন তার দাম ১ লাখ ৮০ হাজার টাকাও নয়। অধিকাংশ পচে গেছে। এসব আলু গরুর খাবার হিসেবে ব্যবহার ছাড়া উপায় নেই।
তিনি আরো জানান, অনেক ব্যবসায়ী ঋণ করে আলু মজুত করেছিলেন, কিন্তু এখন কেউ যোগাযোগ করছেন না। ব্যবসায়িরা যদি আলু না তোলেন তবে কোল্ড স্টোরেজ মালিকেরা ভাড়াই তুলতে পারবেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন চলতি বছরের ২৭ আগস্ট কৃষি মন্ত্রণালয় কোল্ড স্টোরেজের গেটে আলুর ন্যূনতম দাম কেজিপ্রতি ২২ টাকা নির্ধারণ করে এবং অক্টোবর-নভেম্বরে ৫০ হাজার টন আলু কিনে সংরক্ষণের ঘোষণা দেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এই ঘোষণায় কৃষকেরা আশান্বিত হয়ে আলু বিক্রি বন্ধ রাখেন। ফলে বাজারে সরবরাহ কমে, কিন্তু সরকারি ক্রয় শুরু না হওয়ায় দাম আরো পড়ে যায়।
কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, শুরু থেকেই বোঝা যাচ্ছিল অতিরিক্ত উৎপাদন হবে। তাই সরকারকে মৌসুমের শুরুতেই অন্তত ১০-১২ লাখ টন আলু কিনতে হতো। আমরা তখনই এ সুপারিশ করেছিলাম। সরকার রফতানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়নি। উৎপাদন ১.৩ কোটি টন হলেও রফতানি হয়েছে মাত্র ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টন। রফতানি বাজারের সীমাবদ্ধতা কাটাতে পারলে আজকের এই বিপর্যয় এড়ানো যেত।
কৃষি বিপণন অধিদফতর জানিয়েছে, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ হয়েছে গড়ে ১৪ টাকা। বর্তমানে ঢাকার খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ২০ টাকা ও কাওরান বাজারে পাইকারি দাম ১২ টাকা। অথচ কোল্ড স্টোরেজে একই আলু বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকায়। নি¤œ মানের আলুর দাম ৪ থেকে ৬ টাকা, তাতেও ক্রেতা নেই। এমন পরিস্থিতিতে একজন কৃষক যদি ১০ টাকা দরে আলু বিক্রি করেন, উৎপাদন ব্যয় বাদ দিয়ে তার প্রতি কেজিতে ৭ থেকে ১০ টাকা ক্ষতি গুনতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর গড়ে ৭০ শতাংশ আলু বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও বিক্রি হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ। অনেক গুদামে এখনো স্তূপ করে রাখা রয়েছে বিক্রয়হীন আলু, যার অনেকটাই পচে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, আলুর আবাদ মৌসুম প্রায় এসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের এখনই প্রণোদনা না দিলে তারা পরবর্তী মৌসুমে চাষ করতে পারবে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, কৃষকরা এখন সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক কেনার মতো টাকাও হাতে রাখেন না। তাই অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ ও পুনঃঅর্থায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
বাণিজ্য বিশ্লেষকদের মতে, আলুর অতিরিক্ত উৎপাদন নতুন কিছু নয়; তবে এ বছর সরকারি সমন্বয় ঘাটতি ও রফতানি নীতির দুর্বলতার কারণে সঙ্কট প্রকট হয়েছে। ভারতের বাজারে প্রবেশে জটিলতা, শুল্ক-প্রশ্ন এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে দুর্বল সংযোগের কারণে রফতানি সীমিত থেকে গেছে।
বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতি সমিতির প্রাক্তন সভাপতি ড. মো: আজিজুল ইসলাম বলেন, এখনই সময় সরকারকে একটি ‘জাতীয় আলু নীতি’ প্রণয়ন করার। এতে উৎপাদন পরিকল্পনা, সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও রফতানি উৎসাহের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
অতিরিক্ত উৎপাদন ও ক্ষতির কারণে অনেক কৃষক আগামী মৌসুমে আলু চাষ থেকে সরে যাওয়ার কথা ভাবছেন। এতে আগামী বছর দেশে আলুর ঘাটতি ও বাজার অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন। তারা বলছেন, সরকার যদি এখনই হস্তক্ষেপ না করে এবং কৃষকদের আর্থিক সহায়তা ও বাজার নিশ্চয়তার ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এ সঙ্কট শুধু কৃষি খাতে নয়, সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিরিক্ত উৎপাদন, বিপণন ব্যর্থতা, রফতানি স্থবিরতা ও সরকারি নিষ্ক্রিয়তার কারণে দেশের আলু খাত আজ মারাত্মক সঙ্কটে। কৃষকরা লোকসানে জর্জরিত, কোল্ড স্টোরেজে জমে আছে কয়েক লাখ টন বিক্রয়হীন আলু। প্রণোদনা, রফতানি সহায়তা ও কার্যকর ক্রয়নীতি ছাড়া কৃষকেরা আগামী মৌসুমে মাঠে ফিরবেন কিনা সেই প্রশ্ন এখন সময়ের দাবি।



