সাক্ষাৎকার : আবদুল হক

গণজাগরণের ভাষা দিতে হবে রাজনীতিকে

তরুণদের একটা অংশ রাজনীতিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করছে যা একমাত্র প্রতিনিধিত্ব নয়, লাখ লাখ তরুণ সুপ্ত হয়ে আছে যারা এসব রাজনীতিতে জড়িত হচ্ছে না।

রাশিদুল ইসলাম
Printed Edition
সাক্ষাৎকার : আবদুল হক
সাক্ষাৎকার : আবদুল হক

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও চেম্বার নেতা আবদুল হক বলেছেন, হতাশাগ্রস্ত মানুষের মধ্যে আশা জাগানোর জন্য যে রাজনৈতিক দর্শন, অঙ্গীকার বা কর্মসূচি সেটা খুব বেশি দেখতে পাচ্ছি না। জনগণের একটা অভ্যুত্থান, জনজাগরণের ভাষা রাজনীতি দিতে ব্যর্থ হলে সমূহ বিপদের শঙ্কা রয়েছে। তরুণদের একটা অংশ রাজনীতিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করছে যা একমাত্র প্রতিনিধিত্ব নয়, লাখ লাখ তরুণ সুপ্ত হয়ে আছে যারা এসব রাজনীতিতে জড়িত হচ্ছে না।

আবদুল হক মনে করেন ব্যবসায়ী সমাজকেও পুঁজির নতুন দর্শন নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে অলিগার্ক শ্রেণীর উত্থান রোধ করা যাবে না। সম্পদ ও পুঁজির পাচার ঠেকানো সম্ভব হবে না। এজন্যই উদ্যোক্তাদের নবতর দর্শন প্রয়োজন। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলন নিয়ে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে আশাবাদ, যে কারণে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিল, সেখানে সেই অর্থে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা ছিল না। কোনো বিপ্লবী পার্টিও ছিল না। সেই অর্থে দৃশ্যমান কোনো বিপ্লবী নেতাও পিছনে ছিল না। নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আবদুল হক এসব কথা বলেন।

নয়া দিগন্ত : তাহলে জুলাই আন্দোলন নিয়ে যে ব্যাপক প্রত্যাশা বা উচ্ছ্বাস ছিল তা কি ফিকে হতে শুরু করেছে?

আবদুল হক : পরিবর্তনের জন্য এখনো যেসব তরুণ রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত নয় তাদেরকে নতুন দিনের চাহিদা অনুযায়ী রাজনীতিতে শামিল করা গুরুত্বপূর্ণ কারণ পৃথিবীতে যে কোনো বড় বিপ্লবই, সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবগুলো যেমন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস এমনকি ইরানের ইসলামী বিপ্লব তাদের ক্ষেত্রে বিশাল পার্টি পিছনে ছিল। পার্টি না থাকলে যেটা হয় তার একটা চিন্তা কর্মসূচিকে বাস্তবায়নে শক্তি নির্মাণ করার জন্য মিলিশিয়া বা মিলিটারি দরকার হয়। ’৭১-এ স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের সামরিক বাহিনীর বিরাট অবদান ছিল, বিশেষ করে পাকিস্তান আর্মিতে থাকা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তারা কিন্তু প্রথম হতাশা বা অমানিশার অন্ধকার বা অনিশ্চয়তার মাঝে হাল ধরেছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে তাকে স্থায়িত্ব দিয়েছিলেন।

নয়া দিগন্ত : তরুণদের কেউ কেউ বলছেন জুলাই আন্দোলন আরো বড় আন্দোলনের সূচনাপর্ব, তারা কি দম ধরে রাখতে পারবেন?

আবদুল হক : আমিও মনে করি তাই। হতাশ হতে চাই না। আমি মনে করি এই বিপ্লবের বার্তা যাবে বহুদূর। এই তরুণরা পৃথিবীকে আলোড়িত করেছিল। বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ইকোনমিস্ট বলেছিল বাংলাদেশ বিগিংস অ্যাগেইন। বাংলাদেশের একটা নবযাত্রা শুরু হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা যেটি বলতেন যে বাংলাদেশের একটা নবজাগরণ দরকার। এটাকে জাগরিত করার জন্য অনেক রকম শক্তি দরকার, চিন্তা দরকার। এর মধ্যে সংস্কৃতি, চিন্তা, অর্থনীতি, রাজনীতি, সম্পদ বা আয়ের বণ্টনের দর্শন, দার্শনিক এসব ধারা ছাড়াতো বড় রকমের অর্জন করা সম্ভব না।

নয়া দিগন্ত : কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো তো একাট্টা হতে পারল না

আবদুল হক : রাজনৈতিক দলগুলো এই মুহূর্তে বিশাল সংস্কার করে ফেলবে এমনটা নয়। কারণ তারা ক্ষমতার রাজনীতি করে। তাদের আদর্শ নিয়ে অনেক প্রশ্ন করা যায়। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। জনগণ যখন এসে বিদ্যমান শাসককে উৎখাত করে দিলো এই বার্তাটা বুঝা, বিশ্লেষণ করা, এর অন্তর্নিহিত প্রত্যাশাকে ভাষা দেয়া রাষ্ট্রনায়কদের কাজ। বাংলাদেশে নতুন রাজনীতি, নতুন চিন্তা দরকার। নতুন অর্থনীতির দিকনির্দেশনা দরকার। ট্র্যাডিশনাল শিক্ষা দিয়ে হবে না। এমনকি ধর্মীয় চিন্তার ব্যাপারে প্রযুক্তির বিকাশ জরুরি। আল্লাহতায়ালা এজন্যই সফর করতে বলেছেন, জ্ঞান আহরণ করতে বলেছেন। হিকমা বা টেকনোলজির দিকে যাও। আরব থেকে তখন চীন ছিল দূরের দেশ। প্রাচীন সভ্যতা থেকে নবীজি সা: শিক্ষার কথা বলেছিলেন। রাজতন্ত্র বা ইত্যাকার কারণে আমরা ইসলামের প্রথম দিকের অর্জনটা ধরে রাখতে পারিনি। হাজার বছরে মুসলমানদের বিজ্ঞানে কোনো অবদান নেই। তাই এ যাত্রা নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই সব হয়ে যাবে এমনটা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের মনের সুপ্ত বাসনা বা প্রত্যাশাকে বুঝতে হবে এবং ভাষা দিতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা সে আইনের শাসন চায়, সে তার অধিকার চায়, সন্তানের নিরাপত্তা চায়, ভালো উন্ন

নয়া দিগন্ত : রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তন না হলে গুণগত পরিবর্তন কিভাবে আসবে?

আবদুল হক : রাষ্ট্রকে পুনর্বিন্যাস করার বড় কাজটা বিশৃঙ্খলা দিয়ে সম্ভব না। দীর্ঘকাল শাসকরা যে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে তোষণ করেছে, এগুলোকে আঘাত করার মতো পলিটিক্যাল পাওয়ার কই? রাষ্ট্রের ওপর মনোনিবেশ করতে হলে অনেক ক্ষেত্রে অঙ্গহানি করতে হবে।

রাষ্ট্রের যে অঙ্গগুলোতে গ্যাংগ্রিন হয়ে আছে, বিভিন্ন গোষ্ঠী, আমলাতন্ত্র, কাঠামোগত পরিবর্তন অনিবার্য। আমাদের টিকে থাকার জন্য এটা মাস্ট অথবা মরণ। চেঞ্জ অর ডাই। ইউ হ্যাভ টু চেঞ্জ। এটা প্রকৃতির নিয়ম। চেঞ্জের মধ্যেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। চেঞ্জের বার্তাটা পেয়ে অ্যাটওয়ান্স জনগণ রাস্তায় নেমে কিন্তু দিয়ে গেছে। কিন্তু বাকি কাজটার জন্য যে রাজনৈতিক শক্তির উত্থান দরকার সেটা জনগণের হাতে নেই। জনগণ ডু নট বিলং টু অ্যানি পলিটিক্যাল পার্টি। নাইদার অ্যানি পলিটিক্যাল পার্টি ওন দিস রেভুলিউশন ফর দ্যাট ম্যাটার বা ওইভাবে বললে। সেই ক্ষেত্রে জনগণের বিপ্লবকে তরুণরা প্রাণ দিয়ে বাস্তবায়ন করেছে। সে তরুণদের প্রতিনিধি কি কেবল এরাই। এটা মনে করি না। স্কুলের যে ছোট বাচ্চারা আছে তাদের আগামী দিনের নেতৃত্ব হাতে তুলে দিতে এখনই প্রস্তুতি প্রয়োজন। জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে রাজনীতি বুঝতে হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৃতি ও বিশ্বকে বুঝতে হবে দেন ইউ উইল বি অ্যাবল টু ডু দ্যাট। তা না হলে অবধারিতভাবে আজকে আমাদের বাচ্চারা আগামী দিনে স্লেভ বা দাস হয়ে যাবে। বা যে জানে তার কাছে আপনি পরাধীন হয়ে যাবেন।

নয়া দিগন্ত : দীর্ঘদিন ধরে আপনি চেম্বারগুলোর সাথে জড়িত রয়েছেন, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রস্তুতি হিসেবে আমাদের কী করা প্রয়োজন?

আবদুল হক : পুঁজির নতুন দর্শন আমাদের আনতে হবে। পুঁজির ব্যাপারে রাষ্ট্রের নীতি কী হবে? রাষ্ট্র কি অলিগার্ক তৈরি করবে নাকি এমন উদ্যোক্তা তৈরি করবে যে তারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে, সম্পদ গড়ে তুলবে জাপান ও কোরিয়ার মতো। পৃথিবীর যেখানে তুমি যাও নিজের দেশের জন্য তুমি সম্পদ আহরণ কর এই শিক্ষাটা জরুরি আমাদের তরুণদের জন্য। আমাদের দেশে অপরাধী শাসকরা অলিগার্ক শ্রেণী তৈরি করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টা করেছে। এতে অর্থসম্পদ ও পুঁজি পাচার হয়েছে জনগণের বিরুদ্ধে ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে রাষ্ট্র টিকবেই না। উদ্যোক্তাশ্রেণীকে তাই নতুন করে পুঁজির দর্শন নিয়ে ভাবতে হবে। রাজনৈতিক দর্শনে আসতে হবে রাষ্ট্রের অর্থনীতি কিংবা পুঁজির দর্শন অর্থাৎ তরুণদের জন্য আপনি কী দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তরুণদের টাকা বানাতে ও উৎপাদন করতে শিখাতে হবে। কিন্তু তরুণদের অর্জিত সম্পদ যেন সে দেশে রাখে, কর্মসংস্থানে কাজে লাগাতে পারে। সে অন্যকেও ইনোভেট করবে। এবং সে কিভাবে বিশ্ববাজারে টিকে থাকবে এসব জিনিস টোটালি মিসিং বা অনুপস্থিত। রাজনীতি এটা বুঝেই না।

নয়া দিগন্ত : এসব কারণেই কি তরুণরা বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায়

আবদুল হক : রাজনীতিবিদদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়ে। এলিট বা উঁচু শ্রেণীর যারা আছে, মিলিটারি, সিভিল, বিচারপতি, পুলিশ হোয়াটএভার তাদের একমাত্র চিন্তা ছেলেমেয়েরা বাইরে পড়বে আর তারা এখানে শাসন করবে। ছেলেমেয়েরা বাইরে থাকবে এবং তারা দেশকে কলোনির মতো ব্যবহার করতে চায়। দেশকে কলোনির মতো ব্যবহার থেকে বের করা দরকার। কারণ বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গিলে খায় আমরা তেমন সাধারণ মানুষকে গিলে খাচ্ছি। নিচের দিকের ২০ শতাংশ মানুষ হতাশ জাতীয়ভাবে চিন্তা করলে কিন্তু এটা ভয়াবহ ব্যাপার। অ্যালার্মিং। মনে করেন ২০ কোটির মানুষের মধ্যে তারা কোনো আশাই পোষণ করে না। একটা রাষ্ট্রেতো এটা হতে পারে না। এখানেও রাজনীতিবিদদের জন্য অনেক চিন্তা করার বিষয় ছিল। অতএব ব্যবসায়ী চেম্বার বা অ্যাসোসিয়েশনগুলোর নতুন দিকনির্দেশনা দরকার। দেশে যেমন বিরাট পরিবর্তন দরকার তার সারথি কিন্তু ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদেরও হতে হবে। উদ্যোক্তাদের নবতর দর্শনটা হবে জাতীয় পুঁজির বিকাশ। তা না হলে অলিগার্কদের বিরুদ্ধে পাটাতনটা গড়ে তোলা সম্ভব নয়।