অতি উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ রাজধানী ঢাকায়। শব্দদূষণ থেকে বধিরতা ছাড়াও বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি হতে পারে। যারা যত বেশি ঢাকার রাস্তায় থাকেন অথবা কাজ করেন, তাদের অনেকেই কানে শোনেন না। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা রাজধানী ঢাকার কোথাও চোখে পড়ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে ৩০টি কঠিন রোগের কারণ ১২ রকমের দূষণের মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। শব্দদূষণের কারণে উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিণ্ডে ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যেতে পারে। এ জন্য শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, দিক ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো, মানসিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা তৈরি করে।
শব্দদূষণের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় শব্দ তৈরির প্রতিযোগিতা চলে থাকে অনেক সময়। বিশেষ রাজপথে যেসব যানবাহন চলাচল করে এদের সব অতি উচ্চমাত্রার শব্দ করে থাকে। এর বাইরে ইটভাঙার মেশিন, ভবন নির্মাণের প্রকট শব্দ তো আছেই।
নীরব এলাকায় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশের আইনে। কয়েক বছর আগে পরিবেশ অধিদফতরের এক গবেষণায় দেখা যায়, বিভাগীয় শহরগুলোতে শব্দদূষণের মাত্রা ১৩০ ডেসিবল ছাড়িয়ে গেছে। এ মাত্রাটা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। গবেষণা অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার পল্টন এলাকা বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণের শিকার। তবে রাজধানীর সর্বত্রই মারাত্মক রকমের শব্দের অত্যাচার লক্ষ করা যাচ্ছে। যানবাহনের মধ্যে বাসের বিকট হর্নের শব্দ তো রয়েছেই, আবার এর সাথে যোগ হয়েছে মোটরসাইকেলের হর্নের প্রকট শব্দ। কিছু মোটরসাইকেলে, প্রাইভেট কার, বাস ও ট্রাকের হর্ন ফিট করা আছে। ঢাকা শহরে ভাড়ার মোটরসাইকেল চালু হওয়ার পর গত ১০ বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে এই বাহনের সংখ্যা। শব্দের প্রতি এদের কোনো ধারণা না থাকায় এরা ইচ্ছামতো হর্ন বাজিয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে শব্দদূষণের মাত্রা।
নাক-কান ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা: হাফিজুল্লাহ খান শব্দদূষণ সম্পর্কে বলেন, ‘শব্দদূষণের সাথে বধিরতার সম্পর্ক রয়েছে। আকস্মিক তীব্র শব্দে অন্তঃকর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে মানুষ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী প্রতি এক হাজারজনের মধ্যে একজন জীবনের কোনো না কোনো সময় বধির হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া প্রতি এক হাজারজনের মধ্যে একজন বধিরতা নিয়ে জন্মায়। বধির মানুষের জন্য যোগাযোগে শব্দ কোনো ভূমিকাই রাখে না। এমন কেউ নেই যে তার জীবদ্দশায় কানে শোনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে চাইবে। তার পরও মানুষ প্রচণ্ড শব্দ উৎপাদন করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমেরিকান স্পিচ অ্যান্ড হেয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (আশা) গ্রহণযোগ্য শব্দের একটি মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। নির্ধারিত মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফলতা দেখিয়েছে। বাংলাদেশেও শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালায় (২০০৬) শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। বিধিমালার বাস্তবায়ন শব্দদূষণের ক্ষতি থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে। কিন্তু বিধিমালা বাস্তবায়নে কোনো ব্যবস্থা নেই। আইনটি মানার যেমন তাগিদ নেই কোনো পক্ষ থেকে। এ ধরনের কোনো আইন আছে অথবা শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে- এমন কোনো তথ্য রাজধানী ঢাকার বাস, ট্রাক প্রাইভেট কারের ড্রাইভার এবং মোটরসাইকেল চালকরা জানেন না।
শব্দদূষণ করলে এর বিরুদ্ধে আইনে বেশ কড়া ব্যবস্থা আছে। আইনটি ভঙ্গ করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শব্দের উৎসের যন্ত্রপাতি জব্দ করে পারবেন। শব্দদূষণ করলে এবং দোষী প্রমাণিত হলে প্রথম অপরাধের জন্য এক মাসের কারাদণ্ড অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান করা হয়েছে। দ্বিতীয় একই ধরনের অপরাধ করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। বিধিমালায় যা কিছু উল্লেখ আছে তা পালনে ব্যর্থতা অপরাধ হিসেবে ধরা হবে বলেও বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদফতরের একটি জরিপের প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় প্রতিটি শহরের নির্ধারিত স্থানগুলোয় বিধিমালা নির্দেশিত শব্দের মাত্রার চেয়ে শব্দের মাত্রা দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ। প্রতিটি শহরেই শব্দের উৎস হিসেবে যানবাহন এবং হর্নকে শব্দদূষণের জন্য প্রধানত দায়ী করা হয়। এ ছাড়া নির্মাণকাজ, সামাজিক অনুষ্ঠান, মাইকিং, জেনারেটর ও কলকারখানা প্রভৃতি শব্দদূষণের উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।