কর্মসূচি প্রত্যাহার

এনবিআরের সব কার্যক্রম অত্যাবশ্যকীয় ঘোষণা

কাজে যোগদানের নির্দেশ : কঠোর হবে সরকার

আন্দোলনরত এনবিআর-এর সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অনতিবিলম্বে কাজে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতি সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রমকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। একই সাথে আন্দোলনরত এনবিআর-এর সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অনতিবিলম্বে কাজে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতি সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সরকার গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছে যে, রাজস্ব সংস্কারের কাজকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নজিরবিহীনভাবে গত দুই মাস ধরে দেশের ব্যবসাবাণিজ্য, আমদানি-রফতানি এবং রাজস্ব আদায় কার্যক্রম অন্যায় ও অনৈতিকভাবে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে আন্দোলনের নামে চরম দুর্ভোগ তৈরি করেছে যা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য।

বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, সংস্কারের বিরোধিতা ছাড়াও অর্থবছরের শেষ দুই মাসে তারা রাজস্ব আদায় কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই তথাকথিত আন্দোলন পরিকল্পিত ও দুরভিসন্ধিমূলক যা জাতীয় স্বার্থ এবং নাগরিক অধিকারের চরম পরিপন্থী। সরকারের পক্ষ থেকে রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি বিবেচনায় নেয়ার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেয়া হয় এবং আলোচনায় আসার আহ্বান জানালেও তারা তা অগ্রাহ্য করে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান না করে তারা আন্দোলনের নামে অনমনীয় অবস্থান নিয়ে ক্রমাগত দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে চলেছে।

এ পরিস্থিতিতে অতি জরুরি আমদানি-রফতানি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের কার্যক্রম চলমান রাখার জাতীয় স্বার্থে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন সব কাস্টমস হাউজ, আইসিডি, বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক স্টেশনগুলোর সব শ্রেণীর চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস (অ্যাসেনশিয়াল সার্ভিসেস) ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আমরা আশা করি, অনতিবিলম্বে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থলে ফিরে যাবেন এবং আইনবিরোধী ও জাতীয় স্বার্থ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসবেন। অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতির সুরক্ষায় সরকার কঠোর হতে বাধ্য হবে।

বিবৃতিতে এনবিআরকে পুনর্গঠন করার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নমুখী কার্যক্রম পরিচালনার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো দুর্বল রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের রাজস্ব সংগ্রহ অনেক কম। এর মূল কারণ হলো আমাদের রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার নানা দুর্বলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। এ পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার সব অংশীজনের পরামর্শ অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সাথে অর্থ উপদেষ্টার বৈঠক : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

গতকাল রোববার সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। তিনি বলেন, এনবিআর কিভাবে সংস্কার করা যায় সে বিষয়ে কমিটি আলাপ-আলোচনা করবে। তারা সবার কথা শুনবে। জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, তারা ব্যবসাসংক্রান্ত বিভিন্ন কথা বলেছেন।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন-ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, আইসিসিবির সহসভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী, মেট্রো পলিটন চেম্বারের (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান, এমসিসিআইর সহসভাপতি ও ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতির তাসকিন আহমেদ প্রমুখ। বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান মো: আবদুর রহমান খানও উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।

ফাওজুল কবিরের নেতৃত্বে পাঁচ উপদেষ্টার সমন্বয়ে কমিটি : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট বিদ্যমান সঙ্কট দ্রুত নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের পাঁচ উপদেষ্টার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল রোববার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ কমিটির সভাপতি হিসেবে কাজ করবেন। এ ছাড়া সদস্য হিসেবে আছেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

এনবিআরের শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার : জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তথা এনবিআরের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হয়েছে। রোববার দিবাগত রাতে এ ঘোষণা দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। সরকারের কমিটি গঠন ও ব্যবসায়ী সংগঠনের আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। এনবিআরের চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবিতে গত কয়েক দিন ধরে আন্দোলন করে আসছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

চট্টগ্রাম কাস্টমসে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম শুরু : জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ও ‘মার্চ ফর এনবিআর’ কর্মসূচি প্রত্যাহারে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে গতকাল সন্ধ্যার পর আমদানি-রফতানি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফলে সচল হতে শুরু করেছে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। আজ সোমবার থেকে পুরোদমে কার্যক্রম চলবে। কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে শনিবার থেকে গত শনিবার ঢাকার এনবিআর ভবন থেকে শুরু করে দেশের সব কাস্টম হাউজ ও শুল্ক স্টেশনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে। অচল হয়ে যায় চট্টগ্রাম বন্দরও। ফলে এই বন্দরে একদিনে রফতানি হয়নি সাড়ে তিন হাজার কনটেইনার। কর্মসূচি প্রত্যাহার হওয়ায় এখন ধীরে ধীরে বন্দরের কার্যক্রম সচল হচ্ছে।

সরকার গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সব শ্রেণীর চাকরিকে অত্যাবশ্যকীয় সেবা ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি সংস্থাটির আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে ফেরার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, অন্যথায় দেশের জনগণ ও অর্থনীতি সুরক্ষায় সরকার কঠোর হবে। এ অবস্থায় গতকাল সন্ধ্যার পর কাজে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন আন্দোলনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার সাইদুল ইসলাম বলেন, আমদানি-রফতানিসহ সব ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর আগে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ও ‘মার্চ ফর এনবিআর’ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন এনবিআরের আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত রাতে (২৯ জুন) রাজধানীর চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) কার্যালয়ে সাড়ে ৯টায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেয়া হয়। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে আলোচনা শেষে এ সিদ্ধান্ত জানায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ।

সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ীদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন বিসিআই সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন- এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি মির্জা আশিক রানা, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, দেশের শীর্ষস্থানীয় চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এপেক্স ফুটওয়্যারের এমডি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর প্রমুখ।