পতন সামলে পুঁজিবাজারে হঠাৎ সূচকের উল্লম্ফন

সংশোধন হচ্ছে মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা

Printed Edition

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

পাল্টে গেল পুঁজিবাজার আচরণ। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দেখা গেল উল্টো চিত্র। গত রোববার যেখানে দুই পুঁজিবাজার সূচকের বড় ধরনের অবনতি ঘটল সেখানে সোমবার বাজার আচরণ পাল্টে উল্লম্ফন ঘটল সূচকের। ঢাকা পুঁজিবাজারে দিনের এক পর্যায়ে আগের দিন হারানো সূচকের পুরোটা ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি আরো এগিয়ে যায় সূচক। কিন্তু কোন জাদুবলে এটি ঘটল সে প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। তবে দীর্ঘ দরপতনে ক্ষুব্ধ বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ মনে করেন, এটাও একটা খেলা। বিনিয়োগকারীদের শেয়ার কিনতে প্ররোচিত করে আরো বড় বিক্রয়চাপের মাধ্যমে তাদের সর্বস্বান্ত করার কৌশল এটা।

গতকাল লেনদেনের শুরুতেই বিক্রয়চাপের মুখে পড়ে বাজারগুলো। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) আগের দিনের পাঁচ হাজার ৪৪ দশমিক ৩৩ পয়েন্ট থেকে কিছুক্ষণের মধ্যে সূচকটি নেমে আাসে পাঁচ হাজার ২৩ পয়েন্টে। এরপর বিক্রয়চাপ কিছুটা হ্রাস পেলে ঊর্ধ্বমুখী হয় বাজারসূচক। বেলা ১১টায় সূচকটি পৌঁছে যায় পাঁচ হাজর ৮০ পয়েন্টে। সূচকের এ অবস্থান থেকে দ্বিতীয়বারের মতো বিক্রয়চাপ তৈরি হলেও দুপুর ১২টার দিকে তা আবার কাটিয়ে ওঠে বাজারটি। দুপুর ১২টার পর সূচকের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকে যা দিনশেষে সূচকের বড় ধরনের উন্নতি ঘটায়।

ডিএসইর প্রধান সূচকটি গতকাল ৬৭ দশমিক ২৫ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে দিনশেষে পৌঁছে যায় পাঁচ হাজার ১১১ দশমিক ৫৯ পয়েন্টে। একই সময় ডিএসইর দুই বিশেষায়িত সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহর উন্নতি ঘটে যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৬৫ ও ১৮ দশমিক ৮৬ পয়েন্টে। দেশের দ্বিতীয় পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) প্রধান সূচক সিএএসপিআই (সার্বিক মূল্যসূচক) গতকাল ১৮ দশমিক ৮৯ পয়েন্ট উন্নতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এখানে বাজারটির অপর দুই বিশেষায়িত সূচক সিএসই-৩০ ও সিএসসিএক্স সূচকের উন্নতি ঘটে যথাক্রমে ২৮ দশমিক ৪০ ও ১৭ দশমিক ৩১ পয়েন্ট।

সূচকের বড় ধরনের উন্নতি ঘটলেও গতকাল ডিএসইর লেনদেনে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। দীর্ঘসময় বাজারটির লেনদেন ২০০ কোটির ঘরে অবস্থান করছিল। তবে একেবারে শেষ সময়ে এসে বাজার কিছুটা গতি পেলেও চারশো কোটির ঘর স্পর্শ পারেনি। ৩৯২ কোটি টাকার লেনদেন নিষ্পত্তি করে বাজারটি যা আগের দিন অপেক্ষা ৫০ কোটি টাকা কম। রোববার ডিএসইর লেনদেন ছিল ৪৪২ কোটি টাকা। তবে চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে লেনদেন কিছুটা বেড়ে ১০ কোটি টাকা থেকে ১৬ কোটিতে পৌঁছে গতকাল।

এদিকে এক প্রকার অকার্যকর হয়ে পড়া মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে নতুন বিধিমালা তৈরি করতে যাচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। মিউচুয়াল ফান্ডের মতো একটি গুরুত্বপুর্ণ ইন্সট্রুমেন্ট যেভাবে দিনের পর দিন অকার্যকর হতে চলেছে তা থেকে উত্তরণের অংশ হিসেবে প্রচলিত বিধিমালাকে সংশোধন করে এ বিধিমালা তৈরি হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।

প্রসঙ্গত দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ ক্লোজড-এন্ড মিউচুয়াল ফান্ড দীর্ঘদিন ধরে সম্পদমূল্য তথা নিট অ্যাসেট ভ্যালুর (এনএভি) অনেক নিচে লেনদেন হচ্ছে। এটি তাদের দুর্বল পারফরম্যান্সের স্পষ্ট ইঙ্গিত। পাশাপাশি পুঁজিবাজারগুলো বারবার বিপর্যয়ের শিকার হওয়ার কারণেও এটি ঘটেছে। অথচ বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশই ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে পরিচিত এ ফান্ডে বিনিয়োগ করেও অন্যান্য সিকিউরিটিজের মতো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। বিনিয়োগকারীদের এই অচল অবস্থার হাত থেকে মুক্তি দিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনতে যাচ্ছে।

জানা যায়, প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী, কোনো ক্লোজড-এন্ড মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিট যদি তার সম্পদমূল্য (এনএভি) থেকে ২৫ শতাংশের বেশি কম মূল্যে ছয় মাস ধরে লেনদেন হয়, তবে সেই ফান্ড বাধ্যতামূলকভাবে লিকুইডেশন করে ওপেন-এন্ড ফান্ডে রূপান্তর করতে হবে। এই পদক্ষেপটি মূলত ২০১৮ সালে মেয়াদ বাড়ানোয় আটকে থাকা বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বস্তির পথ খুলে দিতে পারে। চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে বিএসইসি জনমত চেয়েছে এবং নতুন করে কোনো ক্লোজড-এন্ড ফান্ডের অনুমতি না দেয়ার প্রস্তাবও করেছে।

তাছাড়া খসড়া অনুযায়ী, ছয় মাসের গড় লেনদেন মূল্য যদি গড় এনএভি (ন্যায্য বা ক্রয়মূল্যের মধ্যে যেটি বেশি) থেকে ২৫ শতাংশের বেশি নিচে থাকে, তবে গেজেট প্রকাশের ছয় মাস পর ফান্ডটি রূপান্তরের আওতায় আসবে। তখন ট্রাস্টিকে বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আহ্বান করতে হবে এবং ইউনিটহোল্ডারদের তিন-চতুর্থাংশের ভোটে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিএসইসি মনে করছে, বছরের পর বছর মিউচুয়াল ফান্ডগুলো অভিহিত মূল্যের অনেক নিচে লেনদেন হচ্ছে যাতে বুঝা যায় এগুলোর ব্যবস্থাপকগণ তাদের ফান্ডের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারছেন না। তাই এগুলোতে ওপেন এন্ডে রূপান্তর করা হলে বিনিয়োগকারীরা যেকোনো প্রয়োজনে তাদের অর্থ তুলে নিতে পারবেন।

আরো জানা যায়, সংশোধনী কার্যকর হলে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো (এএমসি) আর সরাসরি ফান্ডের সম্পদ পরিচালনা করতে পারবে না। পরিবর্তে কাস্টোডিয়ানরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, যাদের ন্যূনতম ২০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন থাকতে হবে। পাশাপাশি সংশোধনীতে কাস্টোডিয়ান ফি ০.১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ০.৫০ শতাংশ পর্যন্ত করারও প্রস্তাব করা হয়েছে।

নতুন বিধিমালায় বিনিয়োগকারীর অর্থের অপব্যবহার ঠেকাতে ফান্ডগুলোকে কেবল তালিকাভুক্ত ও সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের অনুমতি দেয়া হবে। এতে কোনো শ্রেণীতে ঊর্ধ্বসীমা থাকবে না। অতীতে ফান্ড ম্যানেজাররা ফান্ডকে ইচ্ছেমতো বিনিয়োগ করে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়ায় পুরো খাতে বিপর্যয় নেমে আসে যা থেকে আর উত্তরণ ঘটেনি।

বর্তমানে পুঁজিবাজারে ৩৭টি ক্লোজড-এন্ড ফান্ড তালিকাভুক্ত রয়েছে। উল্লিখিত ফান্ডগুলোর মধ্যে মাত্র তিনটি ফান্ড অভিহিত মূল্যের ওপরে লেনদেন হচ্ছে। বাকি ৩৪টি ফান্ডই লেনদেন হচ্ছে অভিহিত মূল্য তথা ১০ টাকার নিচে। আবার এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি লেনদেন হচ্ছে অভিহিত মূল্যের ৫০ শতাংশ নিচে। বিএসইসি আশা করছে, সংশোধনী কার্যকর হলে ফান্ডগুলো রূপান্তর প্রক্রিয়ার আওতায় আসবে। এতে বিনিয়োগকারীরা অন্তত তাদের বিনিয়োগের কিছু অংশ পুনরুদ্ধারের সুযোগ পাবেন এবং বাজারে একটি ইতিবাচক বার্তা পৌঁছাবে।