যে ফুল না ফুটতেই ঝরে গেছে, বা যে নদী মরুভূমিতে হারিয়ে ফেলেছে ধারা-সাহিত্যের ভাষায় সেগুলো হয়তো হার মানে না। কিন্তু অর্থনীতির কঠোর বাস্তবতায়, হার মানা মানেই ধ্বংসের পথে যাত্রা। নিষেধাজ্ঞার কাঁটাতারে বন্দী ইরানের অর্থনীতি আজ ঠিক এমন এক স্রোতে ভেসে যাচ্ছে যেখানে পণ্য রফতানি হচ্ছে, কিন্তু সেই রফতানি থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে ফিরছে না।
৫০ বিলিয়ন রফতানি, ২০ বিলিয়ন ফেরেনি
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরে ইরান ৫০ বিলিয়ন ডলারের অ-তেল পণ্য রফতানি করেছে। কিন্তু এর মধ্যে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার দেশে ফেরেনি। বৈদেশিক মুদ্রার যোগান বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, তৈরি হয়েছে ভয়াবহ ‘মুদ্রা-অস্থিরতার চক্র’ যা শেষ পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে জনগণের কাঁধে বোঝা চাপাচ্ছে। অর্থনীতিবিদ রেজা গুলামি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন তুলেছেন ‘আপনারা বলেন গুঁড়া দুধ আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রা নেই। তাহলে রফতানির সেই অর্থ ফেরাতে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? এতে তো রফতানিকারক জনগণের টেবিল থেকে পণ্যও নিয়ে গেল, আবার মুদ্রাও ফেরাল না।’ তার মতে, যদি শসা রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা ফেরানো না যায়, তবে সেটি দেশে থাকুক অন্তত মানুষ খাক। এতে এক ধরনের বোঝা থাকবে, দুইটি নয়।
‘নিমা’ বিনিময় হার ও বাজারের ভাঙন
ইরানের সরকার রফতানিকারকদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত আনতে ‘নিমা’ নামে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে। এখানে রফতানিকারকরা ডলার বিক্রি করেন, আর আমদানিকারকরা খাদ্য, ওষুধ ও শিল্প কাঁচামাল আমদানি করতে সেই মুদ্রা কিনে নেন। সরকার এ হার সাধারণত মুক্ত বাজারের চেয়ে কম রাখে, যাতে জরুরি পণ্য তুলনামূলক সস্তায় আনা যায়।
কিন্তু যখন ‘নিমা’ হার ও মুক্তবাজার হারের পার্থক্য বেড়ে যায়, রফতানিকারকদের জন্য সরকারি হারে মুদ্রা ফেরানো অলাভজনক হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালে সরকার হার বাড়িয়ে ৬৮,৯০০ তুমান করলেও সমস্যা থেকে গেছে রফতানি অর্থ ফেরত আসেনি।
রফতানি অগ্রাধিকার বনাম দেশীয় সঙ্কট
এ বৈদেশিক মুদ্রা ফেরত না আসার সমস্যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর। ডিটারজেন্ট শিল্প এর একটি উদাহরণ। বর্তমানে খাতটির উৎপাদন সক্ষমতা অর্ধেকে নেমে এসেছে, কারণ গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল যা দেশীয় পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প থেকেই আসা উচিত বিদেশে রফতানি হয়ে যাচ্ছে।
বিস্ময়করভাবে, এ রফতানি হচ্ছে দেশীয় বাজারের দামের চেয়েও কম মূল্যে। সরকারি ন্যূনতম কোটাও অনেক কোম্পানি পূরণ করছে না। ফলে, চাহিদা থেকে সরবরাহ পিছিয়ে পড়ছে এবং দেশীয় উৎপাদন শৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে।
দাম নয়, সরবরাহই সঙ্কট
দেশীয় উৎপাদকরা বলছেন, দাম নয় সরবরাহই আসল সমস্যা। তারা বেশি দাম দিয়েও কিনতে রাজি, কিন্তু পণ্য নেই। যখন দেশীয় চাহিদা জোরালো, তখন কাঁচামাল রফতানি করা হচ্ছে যা অর্থনীতির জন্য এক ধরনের আত্মঘাতী নীতি।
শেষ কথা
প্রশ্নটা সোজা যদি রফতানির অর্থ দেশে ফেরত না আসে, তবে সেই রফতানি কার স্বার্থে? এটি কি ইরানের জনগণের জন্য কোনো লাভ আনে, নাকি কেবল অর্থনীতির নীরব রক্তক্ষরণ বাড়ায়? সমাধান কেবল বিনিময় হারের সামঞ্জস্যে নয় বরং রফতানি ও সরবরাহ নীতিতে কঠোর শৃঙ্খলা আনার মধ্যেই।
ইরানের বর্তমান অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দেয় অর্থনীতি কবিতার মতো সুন্দর হতে পারে না, যদি রক্তক্ষরণ বন্ধ না হয়।