মানবিক করিডোর নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো ঐকমত্যে পৌঁছায়নি

ডিকাব টকে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক

কূটনৈতিক প্রতিবেদক
Printed Edition
ডিকাব টকে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক
ডিকাব টকে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক

বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বহুল আলোচিত ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো ঐকমত্যে পৌঁছায়নি বলে উল্লেখ করে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক (ইউএনআরসি) গোয়েন লুইস বলেছেন, মানবিক করিডোর একটি আনুষ্ঠানিক আইনগত ইস্যু। এতে সংশ্লিষ্ট সার্বভৌম দেশগুলোর সম্মতি প্রয়োজন হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার এবং রাখাইনের গ্রুপগুলোর আনুষ্ঠানিক সম্মতি প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সম্মত হলে মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় জাতিসঙ্ঘ সহায়তা দিতে পারে। তবে এ ধরনের কোনো ঐকমত্য এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা হয়নি।

তিনি বলেন, আন্তঃসীমান্ত সম্পর্ক উন্নয়নের যেকোনো উদ্যোগ, সঙ্ঘাতের কারণে মিয়ানমারে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা দেয়ার যেকোনো প্রচেষ্টাকে জাতিসঙ্ঘ স্বাগত জানায়। তবে এই মুহূর্তে মানবিক করিডোরের কোনো অস্তিত্ব নেই। মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার আলোচনায় জাতিসঙ্ঘ অন্তর্ভুক্ত নয়।

গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সংবাদদাতা সমিতির (ডিকাব) সাথে মতবিনিময়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ সব কথা বলেন। ‘ডিকাব টক’ নামে পরিচিতি অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান মামুন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ডিকাব সভাপতি এ কে এম মঈনুদ্দিন।

নির্বাচনের সময়সীমা ও সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রাধিকার নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলমান বিতর্ক সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে গোয়েন লুইস বলেন, বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক অনুরোধে জাতিসঙ্ঘ নির্বাচন কমিশনকে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সমর্থন করে। তবে নির্বাচন কখন হবে, সংস্কার অগ্রাধিকার পাবে কিনা - এ সব ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের ভূমিকা নেই। এগুলো বাংলাদেশের জনগণ, রাজনৈতিক দল ও সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়। তিনি বলেন, আমরা সংস্কারকে সমর্থন দিতে, নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছি। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতিসঙ্ঘের কোনো ভূমিকা নেই।

অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন বলতে জাতিসঙ্ঘ কী বোঝাচ্ছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হচ্ছে, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী সব নারী ও পুরুষ, নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়সহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। এতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ বোঝানো হচ্ছে না।

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ সংক্রান্ত এক প্রশ্নে গোয়েন লুইস বলেন, আমি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কোনো মন্তব্য করছি না। আমি বলতে চাইছি, জাতিসঙ্ঘ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত নয়। এই প্রশ্ন করতে হবে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে।

গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা নিয়ে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার কার্যালয়ের প্রতিবেদনে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ না করার সুপারিশ করা হয়েছিল। সেই সুপারিশের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধবিষয়ক আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা সুপারিশ করেছি কারণ, সব দলের অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সম্ভাব্য সঙ্ঘাত এড়ানো সম্ভব। এ বিষয়ে আমার বেশি কিছু বলার নেই। এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সরকারের সিদ্ধান্ত।

বাংলাদেশে গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পূর্বপর পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার কার্যালয়ের প্রতিবেদন পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরেছে উল্লেখ করে ইউএনআরসি বলেন, এই প্রতিবেদনের অনেক সুপারিশ অন্তর্বর্তী সরকার বিবেচনায় নিয়েছে। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে জাতিসঙ্ঘ কারিগরি সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বাংলাদেশে ছোট আকারে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারের সাথে চুক্তি সই হবে।

সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা হারাবে কিনা জানতে চাইলে ইউএনআরসি বলেন, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের অবদান বিশাল। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা তাদের কাজে বেশ পারদর্শী। এটা বহু বছর ধরে প্রমাণিত। জটিল পরিস্থিতিতে স্থানীয় মানুষদের সাথে কাজ করতে তারা বেশ দক্ষ। এ কারণে শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করা সব দেশকে আমরা মানবাধিকারের ওপর জোর দেয়ার আহ্বান জানাই। এই বাহিনীতে নিয়োগ পাওয়া সৈন্যরা যাতে জাতিসঙ্ঘের মানদণ্ড পূরণ করে তা নিশ্চিত করা হয়। শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের সুনাম ধরে রাখার জন্য এই মানদণ্ড বজায় রাখতে আমরা বাংলাদেশকে উৎসাহিত করি।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জাতিসঙ্ঘের তৎপর রয়েছে কিনা- প্রশ্ন করা হলে গোয়েন লুইস বলেন, রাখাইনে প্রবেশাধিকার পাওয়া খুবই কঠিন। সেখানকার পরিস্থিতি নাজুক। কেননা সঙ্ঘাত চলছে। রাখাইনে মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সরকার এবং জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন তহবিল (ইউএনডিপি) ও জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল, যা এখনো বহাল রয়েছে। পরিস্থিতির কারণে রাখাইনে জাতিসঙ্ঘের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। তবে আমাদের কিছু সহকর্মী ও অংশীদার এখনো রাখাইনে সক্রিয় রয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সঙ্কট একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ইউএনআরসি বলেন, বাংলাদেশের আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মতো জাতিসঙ্ঘও শরণার্থীদের নিরাপদ ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রত্যাবাসন চায়। বর্তমানে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি খুবই কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। এই পরিস্থিতিতেও আমরা রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেয়া অব্যাহত রেখেছি এবং এটিকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ব্যবস্থাপনায় আমরা বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করছি। রোহিঙ্গা সঙ্কটের একটি রাজনৈতিক সমাধান আমরা আশা করছি। মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত এ লক্ষ্যে অন্যান্য অংশীদারদের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আশিয়ানের সাথে কাজ করছেন।