দীর্ঘ ছয় বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন নিয়ে উৎসবে মেতেছে পুরো ক্যাম্পাস। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনকে ঘিরে প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় পুরো ক্যাম্পাস এখন উৎসবমুখর। ব্যানার, ফেস্টুন আর স্লোগানে মুখর হয়ে উঠেছে টিএসসি, কলা ভবন, কার্জন হল এবং প্রতিটি অনুষদ ও হলের প্রাঙ্গণ। এবারের নির্বাচন শুধু শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের মঞ্চই নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর থেকে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হয়েছে। ডাকসুর কেন্দ্রীয় ২৮টি পদে ৪৭১ জন এবং ১৮টি হল সংসদে ১৩টি পদে মোট ১ হাজার ৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৬২ জন নারী প্রার্থীর অংশগ্রহণ এবার নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে গণসংযোগের মাধ্যমে নিজেদের প্যানেল ও স্বতন্ত্র অবস্থান তুলে ধরছেন।
প্রতিশ্রুতির বন্যা ও প্রধান ইস্যুগুলো : নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই প্রার্থীরা তাদের ইশতেহার প্রকাশ করেছেন। শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদা পূরণ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের নানা বিষয় উঠে এসেছে এসব প্রতিশ্রুতির তালিকায়। প্রধান প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ইশতেহারে কিছু অভিন্ন বিষয় বারবার প্রাধান্য পাচ্ছে।
১) আবাসন সঙ্কট নিরসন : গণরুম সংস্কৃতি বিলোপ করে প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীদের জন্য বৈধ আসন নিশ্চিত করা এবং নতুন হল নির্মাণ।
২) খাদ্যের মানোন্নয়ন : হলগুলোর ক্যান্টিন ও ডাইনিংয়ে ভর্তুকি বাড়িয়ে খাবারের মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ।
৩) পরিবহন সমস্যার সমাধান : বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা চালুর উদ্যোগ।
৪) গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি : গবেষণা খাতে বাজেট বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব ও রিসোর্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা।
৫) নিরাপদ ক্যাম্পাস : যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেলকে আরো কার্যকর করা এবং পুরো ক্যাম্পাসকে সিসিটিভির আওতায় আনা।
৬) সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রম : খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও বাজেট বরাদ্দ।
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ক্যাম্পাসে সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্য দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বাইরে থেকে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যা সমাধানে কাজ করার অঙ্গীকার করছেন।
ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম রেজিস্ট্রার ভবনকে ‘পেপারলেস’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রশাসনিক কাজের দীর্ঘসূত্রতা ও ভোগান্তি কমাতে শিক্ষার্থীরা হল থেকেই অনলাইনে সব ধরনের আবেদন ও পেমেন্ট করতে পারবেন। এ ছাড়া বিদেশে উচ্চশিক্ষায় ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বিশেষ ‘উচ্চশিক্ষা সেল’ গঠনেরও অঙ্গীকার করেছেন তিনি।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও সংশয় : ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকলেও, প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়ও রয়েছে। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ ইকবাল বলেন, আমরা শুধু প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি দেখতে চাই না, এর বাস্তব রূপায়ণ দেখতে চাই। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অতীতেও অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে তার সামান্যই বাস্তবায়িত হয়েছে। ডাকসু যেন ক্ষমতার রাজনীতির অংশ না হয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নিবেদিত থাকে, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
ভোট প্রদান প্রক্রিয়া নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ছাত্রদল মনোনীত ভিপিপ্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, একজন ভোটারকে মোট ৪১টি ভোট দিতে ৮ থেকে ১০ মিনিট সময় লাগতে পারে, যা অল্প সময়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীদের জন্য ভোট দেয়া কঠিন করে তুলবে।
অন্য দিকে, ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও হলের নিয়মকানুন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ক্যাম্পাসে ভবঘুরে ও মাদকাসক্তদের বিচরণ বেড়ে যাওয়ায় নারী শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। নির্বাচনের সময় পরীক্ষা ও ক্লাস চালু থাকায় শিক্ষার্থীরা যোগ্যপ্রার্থী নির্বাচনে ব্যর্থ হতে পারেন, তাই তিনি পরীক্ষা পেছানোর দাবি জানিয়েছেন।
নির্বাচনী পরিবেশ ও নিরাপত্তাব্যবস্থা : নির্বাচনী পরিবেশ উৎসবমুখর হলেও প্রচারণাকে কেন্দ্র করে কিছু উত্তেজনার ঘটনাও ঘটেছে। চারুকলা অনুষদের সামনে একটি প্যানেলের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে রুমমেটকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে স্বতন্ত্র ভিপি প্রার্থী জালাল আহমদ জালালকে হল থেকে বহিষ্কার এবং পরে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনা ক্যাম্পাসে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
প্রার্থীদের অভিযোগ- নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা চলছে। ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ সমর্থিত জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ অভিযোগ করেছেন, কাঠের ফ্রেমে ব্যানার টাঙানোর পরও আচমকা ফোন পেয়ে তাদের ব্যানার সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। সেই সাথে ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ এর ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদেরও আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ করেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ডাকসু রিটার্নিং অফিসার এবং আচরণবিধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলতে এবং পিভিসি বা কাপড়ের ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন।
নির্বাচনকে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে। প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো: মাকসুদুর রহমান জানান, তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হবে। প্রথম স্তরে প্রক্টোরিয়াল টিম, বিএনসিসি ও রোভার স্কাউট, দ্বিতীয় স্তরে বাংলাদেশ পুলিশ এবং বহিরাগতদের প্রবেশ ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি প্রবেশমুখে ‘স্ট্রাইকিং ফোর্স’ হিসেবে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকবে। তবে এই কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ‘মশা মারতে কামান দাগা’র মতো বলে মন্তব্য করেছেন ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি করতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
জাতীয় গুরুত্ব ও ভবিষ্যৎ : বাংলাদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ডাকসু অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এখান থেকেই উঠে এসেছেন দেশের বহু বরেণ্য রাজনীতিবিদ। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন পর এই নির্বাচন দেশের নিস্তরঙ্গ ছাত্ররাজনীতিতে প্রাণ ফেরানোর পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
পিভিসি-ফেস্টুন-বোর্ড ৩টার মধ্যে সরানোর আহ্বান : ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচারণায় আচরণবিধি লঙ্ঘন করে টাঙানো পিভিসি, কাপড় বা অন্যান্য মাধ্যমে তৈরি ব্যানার, ফেস্টুন ও বোর্ড আজ বুধবার (২৭ আগস্ট) বেলা ৩টার মধ্যে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। গতকাল বুধবার এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে ডাকসু রিটার্নিং অফিসার এবং আচরণবিধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানী এই নির্দেশনা দেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আচরণবিধির ধারা-৭(ক) অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারণার জন্য কেবল সাদা-কালো পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল ছাপানো ও বিলি করা যাবে। পিভিসি/কাপড় বা অন্য কোনো মাধ্যমে ছাপানো বা লেখা ব্যানার/ফেস্টুন/বোর্ড টাঙানো যাবে না।
এতে আরো বলা হয়, যেসব প্রার্থী ইতোমধ্যে ব্যানার/ফেস্টুন/বোর্ড টাঙিয়ে প্রচার চালাচ্ছে, তাদের ২৭ আগস্ট বেলা ৩টার মধ্যে তা সরিয়ে নেয়ার জন্য বলা হচ্ছে। সবাইকে আচরণবিধি মেনে প্রচার-প্রচারণা চালানোর নির্দেশনা দেয়া হলো।
গভীর রাতে কোথা থেকে ওহি নাজিল হয় : ফরহাদ
নির্বাচনী আচরণবিধি মেনেই আমরা আমাদের প্যানেলের পরিচিতি করানোর জন্য কাঠের ফ্রেমে আমাদের ব্যানার ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপন করেছিলাম। পরে গভীর রাতে কোথা থেকে হয়তো ওহি নাজিল হয়েছে। ব্যাস, আমাদের ফোন দিয়ে বলা হলো নির্বাচনী আচরণবিধিতে একটু অস্পষ্টতা থেকে যাওয়ায় তা পুনরায় সংশোধন করা হচ্ছে। আপনারা আপনাদের ব্যানার-ফেস্টুনগুলো সরিয়ে নিন- এমন অভিযোগ করেন ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট সমর্থিত জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ।
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রশাসনিক ভবনের সামনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা চলছে : আব্দুল কাদের
‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) পদপ্রার্থী আব্দুল কাদের বলেছেন, আমাদের মনে হচ্ছে প্রতিটা প্রার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলতেছে কে কার চেয়ে বেশি আচরণবিধি লঙ্ঘন করবে। আচরণবিধি যেন নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে, কে আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে সেটা নির্বাচন কমিশন দেখছে না। বরং আমরা দেখতে পেয়েছি, যারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে তাদের এক্সট্রা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে বরং মনোনয়নের জন্য একদিন সময় বাড়িয়ে দিয়েছিল।
তিনি ডাকসু নির্বাচনের নিরাপত্তাব্যবস্থায় আর্মি মোতায়েনের বিষয়ে কাদের বলেন, বিষয়টি ‘মশা মারতে কামান দাগা’র মতো। এখন পর্যন্ত এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নায় যার জন্য আর্মি মোতায়েন করা লাগবে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে, না জানি কী হয়!
আচরণবিধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্স গঠন
ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের এর আচরণবিধি সংক্রান্ত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আচরণবিধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. গোলাম রব্বানীকে আহ্বায়ক করে সত সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যবৃন্দরা হলেন ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম (শহীদুল জাহীদ), শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শারমীন কবীর, মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তানভীর রহমান, সহকারী প্রক্টর ড. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম ও রেজাউল করিম সোহাগ।