২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ হবে আগামী ২ জুন। বাজেটে সরকারের রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে প্রতি বছর নতুন পদক্ষেপ নেয়া হয়ে থাকে। এবারের বাজেটে কর হার বাড়ানোর চেয়ে করের আওতা বৃদ্ধিতে লক্ষ্য বেশি থাকবে বলে জানা গেছে। এ জন্য বেশ কিছু প্রস্তাবনা রাখা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর, শুল্ক কিংবা মূসক বা ভ্যাট খাতে বেশ কিছু পরিবর্তন হতে পারে। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্র, এফডিআরে বিনিয়োগ বিষয়ে শর্ত শিথিল হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, অত্যধিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে স্বস্তি দিতে আগামী বাজেটে বাড়ানো হতে পারে ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা। আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে অপরিবর্তিত থাকছে করহার। বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের আয়ের স্তরভেদে আয়কর দিতে হয়। সাধারণত ২-৩ বছর বিরতিতে আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়। ২০২০-২১ সালে করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়।
আসছে বাজেটে ন্যূনতম কর পাঁচ হাজার টাকা করা হচ্ছে। এতে সিটি করপোরেশন, পৌর এলাকা ও গ্রাম-সব এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম কর পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে। ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা দু-এক অর্থবছর পরপর বাড়লেও ন্যূনতম করহার বাড়ানো হয়নি। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে অঞ্চলভেদে ব্যক্তিশ্রেণীর ন্যূনতম করহার বাড়ানো হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত একই হারে করদাতারা কর দিয়ে আসছেন। এবার কর বৈষম্য কমিয়ে আনতে সব এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম কর পাঁচ হাজার টাকা করা হতে পারে। বর্তমানে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার করদাতাদের ন্যূনতম কর পাঁচ হাজার টাকা, অন্য সিটি করপোরেশন এলাকার করদাতাদের চার হাজার টাকা ও সিটি করপোরেশনের বাইরে পৌর এলাকা ও গ্রামাঞ্চলের করদাতাদের কর তিন হাজার টাকা বিদ্যমান রয়েছে। আর্থিক বৈষম্য কমিয়ে এনে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় সর্বপ্রথম ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে অঞ্চলভিত্তিক করহার চালু করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন গত কয়েক বছর ধরেই সরকার ধারাবাহিকভাবে করপোরেট কর কমিয়েছে। কিন্তু কর কমানোর সুফল ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন না বলে বিভিন্ন সময় তারা দাবি করে আসছেন। বিগত বছরগুলোতে ‘শর্তসাপেক্ষে’ করপোরেট কর কমিয়েছে সরকার। বিরাজমান অস্থিরতা বিবেচনায় ও ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে শর্ত শিথিল হতে পারে। যদিও আপাতত করপোরেট কর কমানো হবে না বলে জানা গেছে। আয়কর বিভাগ বলছে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের অনলাইন রিটার্ন দাখিলে সাড়া পেয়েছে এনবিআর। সে জন্য সরকারি চাকরিজীবীসহ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রায় ১৬ লাখ ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন। আসন্ন বাজেটে অনলাইন রিটার্ন দেয়ার ব্যবস্থা আরো সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। ব্যক্তিশ্রেণীর পাশাপাশি কোম্পানি করদাতাদের অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হতে পারে।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, নতুন করের আওতার মধ্যে আসবে পোশাকশিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল যেমন তুলা এবং মানবসৃষ্ট তন্তু, আলু, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন ও ভুট্টার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য। সার, অপরিশোধিত তেল, চিনি এবং চিকিৎসা সরঞ্জামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া কম্পিউটার প্রিন্টার, রাউটার, মডেম, বিমান ইঞ্জিন, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, শিল্পের যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা সরঞ্জাম, শিল্প রাসায়নিক, বাস, আমদানি করা মাছ ও মাংস, নেটওয়ার্কিং ডিভাইস এবং আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। ভূমি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আসন্ন বাজেটে কিছুটা ছাড় দেয়া হচ্ছে। কাঠার পরিবর্তে শতাংশে নিবন্ধন ফি ও কর নির্ধারণ করা হবে। ভূমি নিবন্ধনে অগ্রিম কর কিছুটা কমানো হতে পারে। তবে এর ফলে ভূমি বা সম্পত্তি নিবন্ধনে কর কমবে না বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। গত অর্থবছর ভূমি নিবন্ধন থেকে এনবিআর প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার কর পেয়েছে।
এদিকে শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউজের লেনদেনের ওপর উৎসে কর কমানো হতে পারে বলে এনবিআর কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়। বাজেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ব্রোকারেজ হাউজের মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে এই কর কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা খুব বেশি না হলেও কিছুটা লাভবান হবেন। এ ছাড়া নতুন নতুন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে শর্ত যেমন সহজ করা হবে, তেমনি কর ছাড়ও দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। বর্তমানে বছরে তিন কোটি টাকার বেশি টার্নওভার হলে ওই প্রতিষ্ঠানকে দশমিক ৬ শতাংশ কর দিতে হয়। এটি আসন্ন বাজেটে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হতে পারে বলে জানা গেছে। বর্তমানে কোম্পানি ও ব্যক্তিগত টার্নওভারে ন্যূনতম কর থেকে সরকার প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব পায়। প্রস্তাবিত এই হার বাড়লে অতিরিক্ত আরো ৩,৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিবন্ধিত দুই লাখ ৮৮ হাজার কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২৪ হাজার ৩৮১টি রিটার্ন দাখিল করেছে। বর্তমানে পাঁচ ধরনের ব্যক্তি ও কোম্পানি করদাতার ওপর শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত ন্যূনতম কর হার রয়েছে। এর মধ্যে কার্বোনেটেড বেভারেজ কোম্পানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে, তামাক কোম্পানির ওপর ৩ শতাংশ হারে, মোবাইল ফোন অপারেটরদের ২ শতাংশ, এবং শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ হলো সেসব ব্যক্তি করদাতার জন্য যাদের বার্ষিক টার্নওভার ৩ কোটি টাকা অতিক্রম করে। বাকি কোম্পানির শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ এবং রফতানিকারকদের ১ শতাংশ ন্যূনতম কর দিতে হয়।
এদিকে মাত্র ছয় মাস আগে ফ্রিজ ও এয়ার কন্ডিশনার প্রস্তুতকারকদের ওপর করপোরেট কর দ্বিগুণ করার পর, এবার তাদের পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে সরকার। ফলে দেশীয় উৎপাদনকারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিতে পারে। বর্তমানে ফ্রিজ ও এয়ার কন্ডিশনারের উৎপাদন পর্যায়ে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে। তবে এনবিআর আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছর তা ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করছে। একইভাবে, মোবাইল ফোন তৈরিতে স্থানীয় মূল্য সংযোজনের ওপর নির্ভর করে ৫ ও সাড়ে ৭ শতাংশ হারে যে ভ্যাট আরোপিত রয়েছে, তা বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ ও ১০ শতাংশ করারও প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাটারি তৈরির ওপরও করপোরেট কর বিদ্যমান সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হতে পারে।
সূত্র মতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী বাজেটের মূল আকার কমছে এমন ধারণা স্পষ্ট বলে এনবিআর সূত্রে জানা যায়।



