দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আর্থিক খাতে কমবেশি শৃঙ্খলা ফিরলেও পুঁজিবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীদের হতাশা কিছুতেই কাটছে না। এরই মধ্যে হঠাৎ করে টানা দরপতন ঘটতে শুরু করেছে পুঁজিবাজারে। গতকাল নিয়ে টানা তিনটি কর্মদিবসে বড় ধরনের পতনের শিকার হলো পুঁজিবাজার। গতকাল দিনশেষে সূচকটি অবস্থান করছিল পাঁচ হাজার ১০৫ দশমিক ৬৮ পয়েন্টে যা এ বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি সূচকটি একবার পাঁচ হাজার ১১২ পয়েন্টে নামলেও পরবর্তীতে তা আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ওঠে।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গতকাল ২৬ দশমিক ৩২ পয়েন্ট হ্রাস পায়। পাঁচ হাজার ১৩২ দশমিক ০১ পয়েন্ট থেকে দিন শুরু করা সূচকটি বুধবার দিনশেষে পাঁচ হাজার ১০৫ দশমিক ৬৮ পয়েন্টে স্থির হয়। এ নিয়ে তিন দিনে ঢাকা শেয়ারবাজারের প্রধান সূচকটির প্রায় ১০০ পয়েন্টের কাছাকাছি অবনতি ঘটে। গত ১০ এপ্রিল সূচকটির অবস্থান ছিল পাঁচ হাজার ২০৫ দশমিক ২৩ পয়েন্টে। সেখান থেকে গতকাল পর্যন্ত টানা পতন ঘটে সূচকটির। একই সময় ডিএসইর অপর দুই সূচক ডিএসই-৩০ ও ডিএসই শরিয়াহ হারায় যথাক্রমে ৫০ ও ২৫ পয়েন্টের বেশি।
সূচকের টানা পতন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে হতাশা তৈরি করছে। দীর্ঘ মন্দায় ধুঁকতে থাকা পুঁজিবাজারগুলো বছরের শুরু থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ফেব্রুয়ারিতে বাজারের লেনদেনও কিছুটা বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি ডিএসইর লেনদেন দীর্ঘদিন পর ৬০০ কোটির ঘর অতিক্রম করে। পরবর্তীতে সূচকেও কিছুটা ইতিবাচক প্রবণতা বিরাজ করলে আশার আলো দেখতে পান বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু গত কয়েক দিনের বাজার আচরণ তাদের আবার হতাশায় ফেলতে শুরু করেছে। সূচকের বড় অবনতির পাশাপাশি কমতে থাকে বাজারের লেনদেনও।
গত ১০ এপ্রিল ডিএসইর লেনদেন ৫৪০ কোটি টাকায় উন্নীত হলেও গতকাল তা আবার ৩৯৬ কোটি টাকায় ঠেকেছে। মাত্র তিন দিনে বাজারটির লেনদেন হ্রাস পায় ১৪৪ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে লেনদেন নেমে আসে পাঁচ কোটিতে। দু’দিন আগেও দেশের দ্বিতীয় পুঁজিবাজারটির লেনদেন ছিল ১৫ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত গত বছরের ৫ আগস্টে সংঘটিত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) নতুন করে সাজানো হয়। আগের কমিশনের সময় বাজারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাপকভাবে অনিয়ম ঢুকে পড়ে। নতুন কমিশন এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অনিয়মের কিছু কিছু সুরাহার চেষ্টা করলেও তাতে তাৎক্ষণিকভাবে বাজার তার ইতিবাচক ফল পাচ্ছে না। অপর দিকে, আগে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে যারা বাজার থেকে অন্যায়ভাবে ফায়দা লুটতে সক্রিয় ছিল তারাও নতুন কমিশন কর্তৃক নেয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কারণে এ মুহূর্তে সক্রিয় নেই। আবার পটপরিবর্তনের পর ব্যাংক ও আর্থিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বাস্তব চিত্র প্রকাশিত হলে আর্থিক খাত যে ধাক্কা খায় তা কাটিয়ে ওঠে পুঁজিবাজারে সাধারণভাবে বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। ফলে টেকসই বাজার পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। এতে কোনো কোনো দিন সাময়িকভাবে বাজারগুলো ইতিবাচক আচরণ করলেও তা টেকসই হচ্ছে না।
পুুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা না ফিরলে পুঁজিবাজার নিয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। তবে বিনিয়োগকারীদেরও চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাজারের সাথে থাকতে হবে। এ পরিস্থিতিতে আতঙ্ক বা হতাশা তাদের জন্য আরো লোকসানের কারণ হতে পারে। তাই তারা মনে করেন, ভালো সময়ের অপেক্ষায় থাকার বিকল্প নেই। আর এ সময় দৈনিক ভিত্তিতে ট্রেডিংয়ের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগই লক্ষ্য হওয়া উচিত। তা না হলে লোকসানের পাল্লা আরো ভারী হতে পারে। তারা অবশ্য মনে করেন, বর্তমান সময়ে বাজারের মূল্যস্তর যেখানে রয়েছে তা থেকে যেকোনো সময় বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে প্রত্যেককে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের কষ্টার্জিত পুঁজি রক্ষায় সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
আগের দু’দিনের মতো গতকালও ডিএসইতে লেনদেনের শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। গতকাল ২৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকায় কোম্পানিটির ২৪ লাখ ৮৯ হাজার শেয়ার হাতবদল হয়। ১২ কোটি সাত লাখ টাকায় ছয় লাখ ৩০ হাজার শেয়ার বেচাকেনা করে দিনের দ্বিতীয় কোম্পানি ছিল ফাইন ফুড লিমিটেড। ডিএসইর লেনদেনের শীর্ষ ১০ কোম্পানির অন্যগুলো ছিল যথাক্রমে ইস্টার্ন লুব্রিকেন্ট, বিচ হ্যাচারি, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, উত্তরা ব্যাংক, শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানি, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, শাইন পুকুর সিরামিকস ও এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড।
একই সময় চট্টগ্রাম শেয়ারবাজারে লেনদেনের শীর্ষ কোম্পানিগুলো ছিল যথাক্রমে লাভেলো আইসক্রিম, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট, ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস, ফু ওয়াং সিরামিকস, বিচ হ্যাচারি, ইস্টার্ন হাউজিং, রবি অজিয়াটা ও উত্তরা ব্যাংক।
ডিএসইতে দিনের মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে ছিল দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। সাধারণ বীমা খাতের এ কোম্পানিটির ১০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। এ ছাড়া খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ৯ দশমিক ৯৯ ও শাহজিবাজার পাওয়ার কোম্পানির ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। মূল্যবৃদ্ধিতে শীর্ষ দশ কোম্পানির অন্যগুলো ছিল যথাক্রমে শার্প ইন্ডাস্ট্রিজ, এনার্জি প্যাক, বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেড, ডরিন পাওয়ার, স্কয়ার নিটিং, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স ও কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স।
দিনের দরপতনের শীর্ষে ছিল এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়্যাল ফান্ড। গতকাল ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ দর হারায় এ ফান্ডটি। এ ছাড়া বিডি ফিন্যান্স ৬ দশমিক ৮৯ ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড ৬ দশমিক ৬ শতাংশ দর হারায়। ডিএসইর দরপতনের শীর্ষ ১০ কোম্পানির তালিকায় আরো ছিল যথাক্রমে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইস্টার্ন ক্যাবলস, রিলায়ান্স ওয়ান মিউচুয়াল ফান্ড, ফার্স্ট জনতা ব্যাংক মিউচুয়াল ফান্ড, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন ও এক্সিম ব্যাংক ফার্স্ট মিউচুয়াল ফান্ড।