ইসরাইলের গোপন সামরিক তথ্য
- মানবাধিকার সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা এটিকে গণহত্যা বলেছেন
- গাজায় পূর্ণ দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করেছে জাতিসঙ্ঘ
- শর্ত দিয়ে আলোচনা শুরুর নির্দেশ নেতানিয়াহুর
ইসরাইলের গোপন সামরিক নথি অনুসারে, গাজা যুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনিদের ৮৩ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক। এই তথ্য প্রকাশ করেছে ইসরাইলি প্লাস নাইন সেভেন টু ম্যাগাজিন ও ব্রিটিশ দ্য গার্ডিয়ান যৌথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে। মে মাস পর্যন্ত ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) যোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত ৮ হাজার ৯০০ জন নিহত হয়েছে। খবর : মিডল ইস্ট আই, আলজাজিরা ও এএফপির।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ওই সময়ে মোট নিহতের সংখ্যা প্রায় ৫৩ হাজার। এর মানে মাত্র ১৭ শতাংশ নিহত যোদ্ধা, বাকি ৮৩ শতাংশ বেসামরিক নাগরিক। গোপন তালিকায় রয়েছে ৩৪ হাজার ৯৭৩ হামাস সদস্য এবং ১২ হাজার ৭০২ জন পিআইজে সদস্য। এদের মধ্যে নিহতদের বেশির ভাগই সংগঠনের নিম্নস্তরের সদস্য। শীর্ষস্থানীয় ৭৫০ সদস্যের মধ্যে মাত্র ১০০-৩০০ জন নিহত হয়েছে।
তবে ইসরাইলি সেনারা অনেক মৃত বেসামরিককেও যোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। লোকাল কল ও +৯৭২ ম্যাগাজিন অনুসারে, নিহত অনেক ফিলিস্তিনি হামাস বা পিআইজের সাথে সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও তাদের ‘যোদ্ধা’ হিসেবে রিপোর্ট করা হয়েছে। সেনাবাহিনী চাইলে যাচাই ছাড়া নিহতদের যোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারত।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বেসামরিক নিহতের হার ৮৩ শতাংশেরও বেশি হতে পারে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া বহু লাশ এতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ ছাড়া পুলিশ সদস্য বা প্রশাসনিক কাজে যুক্ত ব্যক্তিদেরও তালিকায় যোদ্ধা হিসেবে দেখানো হয়েছে। মে মাসের পর থেকে বেসামরিকদের মৃত্যু আরো বেড়ে গেছে। শুধু ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ইসরাইলের মানবাধিকার সংস্থা বেতসেলেম গাজায় ইসরাইলের অভিযানকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আধুনিককালের যুদ্ধে বেসামরিকদের এত বড় অংশের মৃত্যুর ঘটনা বিরল। ১৯৮৯ সালের পর স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যা, রুয়ান্ডার গণহত্যা এবং ইউক্রেনের মারিউপোলে রাশিয়ার অবরোধ ছাড়া অন্য কোনো সঙ্ঘাতে বেসামরিক মানুষের এত বেশি মৃত্যু দেখা যায়নি।
গাজার যুদ্ধকে ‘অবশ্যম্ভাবীভাবে গণহত্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অধ্যাপক ওমর বার্তভসহ অনেক খ্যাতিমান ইসরাইলি ও ইহুদি গবেষক। গোপন তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে বড় অংশই নিম্নস্তরের সংগঠন সদস্য। তবে ইসরাইলের সেনারা প্রায়ই যাচাই ছাড়া বেসামরিকদের যোদ্ধা হিসেবে রিপোর্ট করেছে। এতে বেসামরিক হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, ইসরাইলি সেনারা বেসামরিকদের সঠিকভাবে আলাদা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং অনেককে যোদ্ধা হিসেবে ভুলভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গাজার বেসামরিকদের এত বড় হার হত্যার ঘটনা আধুনিককালে বিরল এবং এটি মানবাধিকার আইন ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রশ্ন তোলে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসামরিকদের প্রাণহানি শুধু যুদ্ধ পরিস্থিতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অবকাঠামো ধ্বংস, ত্রাণ বিতরণ লাইনে নিহত এবং হাসপাতাল ও বিদ্যালয় ধ্বংসের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও যুদ্ধ আইন সম্পর্কিত বিতর্ককে আরো তীব্র করেছে।
গাজায় পূর্ণ দুর্ভিক্ষ চলছে : ফিলিস্তিনের গাজা নগরে দুর্ভিক্ষ চলছে এবং এই পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। গতকাল শুক্রবার রোমভিত্তিক খাদ্যনিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইপিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার পাঁচ লাখ মানুষ ভয়াবহ অনাহারে ভুগছে। এই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে প্রথমবারের মতো রেকর্ড করা হলো।
জাতিসঙ্ঘের মানবিক সহায়তা প্রধান টম ফ্লেচার বলেছেন, এই দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। তবে ইসরাইলের পরিকল্পিত বাধার কারণে ফিলিস্তিনি অঞ্চলে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, ইসরাইল প্রতিবেদনটি খণ্ডন করেছে। তাদের দাবি, ‘গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ নেই।’ ইসরাইল আইপিসির প্রতিবেদনকে মিথ্যা ও হামাসের প্ররোচনামূলক প্রচার হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
আইপিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ আগস্ট পর্যন্ত গাজা নগরী দুর্ভিক্ষের সর্বোচ্চ ধাপে (ধাপ ৫) পৌঁছেছে। এই ধাপ হলো খাদ্যনিরাপত্তার সূচকে সর্বোচ্চ ও মারাত্মক পর্যায়। গাজা নগরীর প্রায় ২০ শতাংশ এলাকায় এ দুর্ভিক্ষের প্রভাব বিস্তৃত। আইপিসি জানিয়েছে, যখন পরিবারগুলো সব ধরনের চেষ্টা করেও খাদ্য বা অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারে না, তখনই ধাপ ৫-এর দুর্ভিক্ষের ঘোষণা দেয়া হয়।
আইপিসি আরো জানিয়েছে, চলতি ২২ মাসের সঙ্ঘাতে গাজা উপত্যকার পাঁচ লাখের বেশি মানুষ অনাহার, দারিদ্র্য ও মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে এই সংখ্যা নির্ধারিত হয়েছে। সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ভুক্তভোগীর সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ ৪১ হাজারে পৌঁছবে। অর্থাৎ গাজার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এই দুর্ভিক্ষের শিকার হবে।
আইপিসি দুর্ভিক্ষ সংজ্ঞায় তিনটি মানদণ্ড ব্যবহার করে। প্রথমত, কমপক্ষে ২০ শতাংশ পরিবার খাদ্য ঘাটতিতে থাকবে। দ্বিতীয়ত, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগবে। তৃতীয়ত, প্রতিদিন ১০ হাজার মানুষের মধ্যে কমপক্ষে দুইজন সরাসরি ক্ষুধা বা অপুষ্টিতে মারা যাবে।
আলোচনা শুরুর নির্দেশ নেতানিয়াহুর : ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, গাজা যুদ্ধ শেষ করতে অবশিষ্ট বন্দীদের মুক্তির শর্তে তিনি আলোচনা শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, গাজা সিটিতে হামলার পরিকল্পনা মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে। এ সময় নেতানিয়াহু উল্লেখ করেছেন, গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নেয়া এবং হামাসকে পরাজিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
গত সপ্তাহে কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় তৈরি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নিয়েছে হামাস। এই প্রস্তাব অনুযায়ী অর্ধেক বন্দী মুক্তি পাবে। তবে নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি শুধুমাত্র সেই চুক্তি মেনে নেবেন যেখানে সব বন্দী এক সাথে মুক্তি পাবে। যুদ্ধবিরতি শর্তগুলোর মধ্যে থাকবে হামাসকে নিরস্ত্র করা, গাজার সামরিকীকরণের অবসান, উপত্যকার চারপাশে ইসরাইলি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং নতুন প্রশাসন গঠন।
আরো ৪৭ ফিলিস্তিনি নিহত : এ দিকে গত শনিবার সকাল থেকে ইসরাইলি হামলায় গাজায় ৪৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। গাজার হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে ৩১ জন গাজা সিটিতে মারা গেছেন। গাজার সবচেয়ে বড় শহরটি দখল করার লক্ষ্যে তীব্র হামলা চালাচ্ছে ইসরাইলি সেনারা। কমপক্ষে পাঁচজন নিহত ব্যক্তি সাহায্য নিতে গিয়ে মারা গেছেন।
গাজার পরিস্থিতি ক্রমেই মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হচ্ছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ ও অন্যান্য মৌলিক সেবার তীব্র ঘাটতির কারণে সাধারণ মানুষ বিপন্ন। আইপিসি এবং জাতিসঙ্ঘের সতর্কতা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অবিলম্বে হস্তক্ষেপ না করলে গাজায় দুর্ভিক্ষ আরো বৃদ্ধি পাবে।
মানবিক সংগঠনগুলো আশা করছে, সশস্ত্র সঙ্ঘাত বন্ধ এবং গাজার জনগণের জন্য ত্রাণ ও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেয়া হবে। অন্যথায়, এটি মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সঙ্কটের রূপ নেবে।