ডাকসু-জাকসু নির্বাচনে ভূমিধস পরাজয়ের পর ছাত্রদলের তৃণমূল ও হাইকমান্ডের কাছে প্রশ্নবৃদ্ধ হয়ে উঠেছেন ছাত্রদলের বর্তমান সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির। দলীয় হাইকমান্ডের তোপের মুখে পড়েছে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা দায়িত্বশীলরাও।
বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা যায়, ডাকসু নির্বাচনের পর বিএনপির হাইকমান্ডে নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ চুলচেরা পর্যালোচনা করা হয়। সেই পর্যালোচনায় উঠে আসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাস্তবিক অর্থে ছাত্রদলের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম তুলে ধরতে পারেনি বর্তমান নেতৃবৃন্দ। ছাত্রদলের কার্যক্রম বেগবান করতে এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রদলকে পৌঁছে দিতে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন ছিল তা নিতে ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সংগঠনটির দায়িত্বে থাকা বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল। এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি করার মাধ্যমে ছাত্রদলকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছে দলীয় হাইকমান্ড। সে ক্ষেত্রে ডাকসুর নির্বাচনে অংশ নেয়া আবিদ-হামিম-মায়েদকে নিয়ে আসা হতে পারে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্বে।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন দলের সচেতন মহল। তারা দলের হাইকমান্ডকে মতামত দিয়ে বলেছিলেন, ছাত্রদল দীর্ঘসময় ক্যাম্পাসগুলোতে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি। সেই বাস্তবতার নিরিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে ছাত্রদলে অংশগ্রহণ করা উচিত হবে না। তবে শিবিরকে কেউ ভোট দিবে না এমন যুক্তিতে নির্বাচনের পক্ষে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে রাজি করাতে সক্ষম হয় বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল। ফলে পূর্ব থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, প্রার্থী নির্বাচন ও সম্ভাব্য রেজাল্ট সম্পর্কে কোনো রকম পর্যালোচনা না থাকায় নির্বাচনে ভরাডুবি হয় ছাত্রদলের। এর ফলে জাতীয় রাজনীতিতেও নেগিটিভ মেসেজ যায়।
দলীয় সূত্রটি আরো জানায়, ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের পরাজয়ের পেছনে দলীয় মতবিরোধও কাজ করেছে। বিশেষ করে ডাকসু নির্বাচনে ভিপি, জিএস ও এজিএস পদে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন প্রথমে দলীয় ফোরামে প্রার্থী হিসেবে তাদের নাম প্রস্তাব করা হলে বিরোধিতা করেন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির। ফলে নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পরও একাধিক বৈঠকে কারা প্রার্থী হবেন তা ঠিক করতে পারেননি বকুল, রাকিব, নাসির। শেষ পর্যন্ত প্রার্থী নির্বাচনের জন্য ভোটাভুটির সিদ্ধান্ত নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পরে দলের অভ্যন্তরে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন আবিদ, হামিম ও মায়েদ।
ফলে প্রার্থীরা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি-সাধারণ-সম্পাদকের পূর্ণ সহযোগিতা পায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। আর যতটুকু তাদের সহযোগিতা পেয়েছেন তাকে দায়সারা ভূমিকা বলে উল্লেখ করেছেন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা।
দলীয় সূত্রে আরো জানা যায়, নির্বাচনের পরও নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা বকুল সিন্ডিকেট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ভুল বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। তারা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন বিজয়ীরা ১৫ কোটি টাকা খরচ করে ভোট ক্রয় করেছেন এবং প্রচুর ভোট কারচুপি হয়েছে। কিন্তু নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক মহলসহ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বলে জানা যায়।
দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, ছাত্রদলকে পুরনো ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনতে অবিলম্বে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের দিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে। বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদককে ব্যর্থতার দায়ে এই পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে ছাত্রদলকে সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে।
রাজনৈতিক সমালোচকরা বলছে, ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেবে কি না এ নিয়ে শুরু থেকেই এক ধরনের দ্বিধা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলো যখন ক্যাম্পাসে নানাভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে, তখনো ছাত্রদল নিজেদের প্যানেল ঘোষণা করতে পারেনি। ভিপি পদে প্রার্থী কে হবেন, সে বিষয়ে সংগঠনটির কর্মী-সমর্থকদেরও স্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। ভোটের মাত্র ২০ দিন আগে প্যানেল ঘোষণা করে ছাত্রদল।
পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকা, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব এবং প্রচারণা কৌশল কী হবে, তা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ছাত্রদলের মধ্যে সঠিক সমন্বয় দেখা যায়নি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরে ছাত্রশিবির যেভাবে তাদের দুই নেতা আবু সাদিক কায়েম ও এস এম ফরহাদকে ক্যাম্পাসে নানাভাবে ‘ফোকাস’ (সামনে আনা) করেছে ছাত্রদল সে অর্থে তাদের কোনো নেতাকে শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরতে পারেনি। উল্টো ভিপি পদে ছাত্রদলের হয়ে কে নির্বাচন করবেন, সেটি ভোটের তফসিল ঘোষণার পরও নিশ্চিত করে কেউ জানত না।
ডাকসু-জাকসু নির্বাচনের পরে ছাত্রদলের কমিটি কিভাবে সাজানো প্রয়োজন এমন প্রশ্নের জবাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা: শাখাওয়াত হোসেন সায়ান্ত নয়া দিগন্তকে বলেন, ছাত্রদল দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি গঠনের পথে হাঁটছে। আমার কাছে মনে হয় এখনই সময় এসেছে একদম ফ্রেশ ছাত্রদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার। এ ছাড়া যাদের নেতৃত্বে আনা হবে খেয়াল রাখতে হবে তাদের আচরণে যেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মনে না হয় যে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাইতে আলাদা। তারা যেন নিজেদেরকে অসাধারণ বা পাওয়ারফুল ব্যক্তি হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন না করে। নতুন নেতৃত্বের কাজ হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। তাদের বন্ধু হওয়া। সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে নানামুখী উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আস্থাভাজন হওয়া।