সঙ্কটে দেশের পোলট্রি শিল্প

প্রতি মাসে খামারিদের ক্ষতি প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা

উৎপাদন খরচের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, খামার পর্যায়ে উৎপাদিত ডিমের দরপতন এবং বাজারব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে টিকে থাকতে পারছেন না ছোট ও মাঝারি খামারিরা।

শাহ আলম নূর
Printed Edition

বাংলাদেশের পোলট্রি শিল্প এক গভীর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন খরচের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, খামার পর্যায়ে উৎপাদিত ডিমের দরপতন এবং বাজারব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে টিকে থাকতে পারছেন না ছোট ও মাঝারি খামারিরা। শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিম ও ব্রয়লার উৎপাদনে প্রতি মাসে খামারিদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কয়েক হাজার খামার বন্ধ হয়ে গেছে, যা গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তার জন্য অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

দেশের খামারিরা বলছেন, বর্তমানে একটি ডিম উৎপাদনে খরচ পড়ছে গড়ে ১০ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১১ টাকা পর্যন্ত। অথচ পাইকারদের কাছে সেই ডিম বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র সাত টাকা ৫০ পয়সা থেকে আট টাকায়। অর্থাৎ প্রতিটি ডিমেই গড়ে দুই থেকে আড়াই টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে উৎপাদককে। একই চিত্র ব্রয়লার মুরগির ক্ষেত্রেও। প্রতি কেজি ব্রয়লার উৎপাদনে খরচ পড়ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা, অথচ খামার পর্যায়ে বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১২২ থেকে ১২৫ টাকায়।

তারা বলছেন, এই লোকসান দীর্ঘদিন বহন করা সম্ভব নয়। রাজশাহীর এক খামারি জানান, শুধু খাদ্য ও বাচ্চার দামই এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিক্রির অর্থে খরচ ওঠে না। ফলে বাধ্য হয়ে খামার বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এদিকে খামার পর্যায়ে দাম পড়ে গেলেও ভোক্তা পর্যায়ে সেই প্রভাব খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে এখনো প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১০-১১ টাকা দরে। একই সাথে ব্রয়লার মুরগির দামও তুলনামূলকভাবে বেশি। এই তারতম্যের মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে মধ্যস্বত্বভোগী ও বাজার সিন্ডিকেটের শক্তিশালী ভূমিকা।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্যে দেখা যায়, ডিম ও মুরগির সরবরাহ ব্যবস্থার বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ডিম থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৩৩০ কোটি টাকা এবং ব্রয়লার মুরগি থেকে প্রতি কেজিতে প্রায় ৪০ টাকা লাভ করছে এই চক্র। বিপরীতে, খামারিরা প্রতি ডজন ডিমে ২০ থেকে ২৬ টাকা এবং ব্রয়লার মুরগিতে কেজিপ্রতি ১১-১২ টাকা লোকসান গুনছেন।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকার ২০২৪ সালের মার্চে ডিম ও মুরগিসহ ২৯টি পণ্যের উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয়। সে অনুযায়ী, ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ধরা হয় ১৪৫ টাকা ৭৮ পয়সা, উৎপাদক পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য ১৫১ টাকা ৮১ পয়সা এবং খুচরা পর্যায়ে ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সা। ডিমের ক্ষেত্রেও উৎপাদন খরচ ও বিভিন্ন স্তরের দাম নির্ধারিত ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই মূল্য কাঠামো মাঠপর্যায়ে কার্যকর হচ্ছে না। খামারিরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামের কথা বললে পাইকাররা পণ্য না নেয়ার হুমকি দেন। ফলে বাধ্য হয়েই লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোলট্রি খাদ্যের প্রধান কাঁচামাল ভুট্টা ও সয়াবিনের আন্তর্জাতিক দাম কমলেও দেশের বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। তাদের অভিযোগ, স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য উৎপাদন ও বিপণনে কিছু কোম্পানির প্রভাব থাকায় দাম কৃত্রিমভাবে বেশি রাখা হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ কমার সুযোগ থাকলেও খামারিরা তার সুফল পাচ্ছেন না।

বিপিআইসিসির নেতারা সতর্ক করে বলছেন, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে শুধু ব্যাপক কর্মসংস্থান হারানোর ঝুঁকিই নয়, বরং পুরো বাজার বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তখন প্রতিযোগিতা কমে গিয়ে ভোক্তা পর্যায়ে দাম হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে বলে তারা মনে করছেন। একজন শিল্প নেতা বলেন, বর্তমানে হয়তো কিছুটা কম দামে ডিম-মুরগি পাচ্ছেন ভোক্তারা। কিন্তু ছোট খামার ধ্বংস হয়ে গেলে বাজার একচেটিয়া হয়ে যাবে। তখন দরিদ্র মানুষের জন্য প্রাণিজ প্রোটিন কেনা কঠিন হয়ে পড়বে।

পোলট্রি শিল্পের উদ্যোক্তারা সরকারের কাছে কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ দাবি করেছেন। তারা বলছেন, ডিম ও মুরগির জন্য কার্যকর ন্যূনতম ও সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ, খাদ্য কাঁচামালের দাম কমাতে হস্তক্ষেপ, ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য জরুরি পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা এবং অফ-সিজনে ভর্তুকি প্রদান করতে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তারা বলছেন, একই সাথে গোশত ও ডিম সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন, রফতানি বাজার অনুসন্ধান এবং বাজার তদারকি জোরদার করে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছেন তারা।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পোলট্রি শিল্প শুধু একটি ব্যবসা নয়, এটি দেশের পুষ্টি নিরাপত্তা, গ্রামীণ অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের সাথে সরাসরি জড়িত। এই খাতকে অবহেলা করলে তার প্রভাব পড়বে পুরো খাদ্যব্যবস্থায়। তাই সময় থাকতেই কার্যকর নীতিগত ও প্রশাসনিক উদ্যোগ না নিলে সঙ্কট আরো গভীর হবে বলে তারা মনে করছেন।