১৫ নভেম্বর। উপকূলের মানুষের কাছে একটি বিষাদময় দিন। ২০০৭ সালের এই দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ প্রচণ্ড আঘাত হানে সমগ্র উপকূলীয় এলাকায়। মুহূর্তেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সবকিছু। প্রাণ হারায় শত শত মানুষ। একই পরিবারের প্রায় সবাই মারা গেছেন, এমন নজিরও খুঁজে পাওয়া যায়। লাখ লাখ গবাদি পশু, হাঁস-মুরগিসহ প্রাণিকুল হয়ে যায় ক্ষত-বিক্ষত। জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি সমগ্র উপকূল পরিণত হয় বিরাণভূমিতে। সব মিলিয়ে সমগ্র উপকূলজুড়ে নেমে আসে এক মানবিক বিপর্যয়।
এমনি অবস্থার সচিত্র খবর খুবই গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করে পাঠকপ্রিয় জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্ত । স্থানীয় সংবাদদাতা ছাড়াও ঢাকা অফিস থেকে ছুটে আসেন সাংবাদিকরা। দৈনিক নয়া দিগন্তের তৎকালীন প্রধান আলোকচিত্রী শফিউদ্দিন বিটুর তোলা- গাছের মাথায় মানুষের লাশের ছবি দেখে কেঁপে উঠেছে মানুষের বিবেক। আবার দুর্গম পথ মাড়িয়ে তৎকালীন বিশেষ সংবাদদাতা (বর্তমানে চিফ রিপোর্টার) আবু সালেহ আকনসহ অন্য রিপোর্টারদের সরেজমিন প্রতিবেদনগুলোও ছুঁয়ে গেছে লাখো মানুষের হৃদয়। শুধু খবর প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করেনি গণমানুষের পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্ত । ত্রাণ তহবিলের মাধ্যমে পাশে গিয়ে দাঁড়ায় অসহায় মানুষের। বিত্তবান মানুষের দেয়া অর্থ, ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী ‘আমানত’ হিসেবেই যথাযথ গুরুত্ব সহকারে পৌঁছে দেন নয়া দিগন্ত পরিবারের সদস্যরা।
শুরু থেকেই নয়া দিগন্তের একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এসব ত্রাণ বিতরণের বেশ কিছু দায়িত্ব ছিল আমার কাঁধে। নয়া দিগন্ত ঢাকা অফিসের নির্দেশনা আর স্থানীয় সহকর্মীদের সাথে নিয়ে পালন করতে হয় সেই দায়িত্ব। বরিশাল থেকে পিকআপ ভ্যান কিংবা লঞ্চে এসব ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হয় প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সংবাদদাতা ও বরিশাল প্রিয়জন সমাবেশের সদস্যরা আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার প্রতিটি উপজেলায় পৌঁছানো হয় নয়া দিগন্ত ত্রাণ তহবিলের ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় একাধিকবার ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়।
এ দিকে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের ফাঁকে ফাঁকে অনেক মানবিক ফিচার প্রকাশ করেছে নয়া দিগন্ত । এসব ফিচার প্রকাশের পর পাঠকের ব্যাপক সাড়াও পাওয়া গেছে। ২ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখের দৈনিক নয়া দিগন্তের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছে- পাথরঘাটার নব্বই বছরের বৃদ্ধ ইসমাঈলের বেঁচে থাকার কাহিনী ‘মোর জামাইরে বাঘে খাইছে’। ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে গলাচিপার চরবিশ্বাসের শিশু রুবেলের ঘর ভাঙার কাহিনী- ‘ডেকসোডা না থাকলে হেইদিন মোরা মইররাই যাইতাম’। এসব রিপোর্টের পর দেশ-বিদেশের মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে। বৃদ্ধের জন্য সহায়তা পাওয়া গেছে, শিশু রুবেলের ভেঙে পড়া ঘর উত্তোলনের ব্যবস্থা হয়েছে। মানুষের এমন প্রতিক্রিয়া পাওয়ার পর বাস্তবিকভাবেই আমরা অনুভব করেছি- আসলেই ‘মানুষ মানুষের জন্য’।
শুধু ত্রাণ বিতরণই নয়, গুরুত্বের সাথে চলে পুনর্বাসন কার্যক্রমও। দৈনিক নয়া দিগন্ত ত্রাণ তহবিলের এসব পুনর্বাসনের আওতায় যারা এসেছেন তাদের অনেকেই এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। গরু, পাল, নৌকা, জাল, রিকশা, ভ্যান, ঘর, সেলাই মেশিনসহ নানা রকম পুনর্বাসন সামগ্রী পেয়ে নিজ পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে অনেক অসহায় মানুষ।
সিডরে সহায় সম্বল হারানো বরিশাল নগরীর বিবির পুকুর পাড়ের পত্রিকা বিক্রেতা বাকপ্রতিবন্ধী আনিসুর রহমানকে নয়া দিগন্ত ত্রাণ ও পুনর্বাসন তহবিলের পক্ষ থেকে তৈরি করে দেয়া হয় একটি পত্রিকা স্টল। সেই স্টলে বসে পত্রিকা বিক্রি করে এখনো সংসার চালান বরিশালের পরিচিত হকার বাকপ্রতিবন্ধী আনিসুর রহমান।
বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির অফিস সহকারী উত্তম বাবু পেয়েছেন নয়া দিগন্ত ত্রাণ তহবিলের দেয়া ভ্যান। সেই ভ্যান দিয়ে জীবিকা নির্বাহের পথ অনেকটাই সুগম করেছেন তিনি। এমনিভাবে শত শত অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে দৈনিক নয়া দিগন্ত।
তখন নয়া দিগন্তের ত্রাণ পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক মানুষের মুখে হাসি ফুটলেও সেদিন তাদের চোখেমুখে ছিল স্বজন হারানোর বেদনা। সিডর যেন এক নির্মম ইতিহাস হয়ে থাকছে তাদের জন্য।



