- চাপিয়ে দেয়া ‘যুদ্ধ’, ‘শান্তি’ মানবে না ইরান
- মোসাদের ড্রোন কারখানা ধ্বংস
- ইরানের সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা
- আরেকটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত
- মিসাইল প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে ইসরাইলের
- তেলআবিব ও জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ
- তেহরানের বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেছেন, তার দেশ ‘চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ’ ও ‘শান্তি’ কোনোটাই মেনে নেবে না। তিনি ইরানের ভূখণ্ডে যেকোনো মার্কিন হামলার ‘গুরুতর অপূরণীয় পরিণতির’ হুশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, ইরান কারো কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। গতকাল বুধবার টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে খামেনি এ কথা বলেন। দেশটির সংবাদ সংস্থা তাসনিমের বরাত দিয়ে আলজাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
খামেনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, যারা ইরান ও এর ইতিহাস জানে তারা জানে, ইরানিরা হুমকির ভাষার প্রতি ভালো সাড়া দেয় না। আমেরিকানদের জানা উচিত যে, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সামরিক হস্তক্ষেপ নিঃসন্দেহে অপ্রতিরোধ্য পরিণতি বয়ে আনবে, বলেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা।
এ দিকে ইসরাইলের আরো একটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার খবর জানিয়েছে ইরান। এ নিয়ে ইসরাইলের পাঁচটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করল দেশটি। অন্য দিকে ইসরাইল গতকাল ইরানের ৪০টি স্থানে হামলা চালানোর দাবি করেছে। এসব বিস্ফোরণে তেহরান কেঁপে ওঠে, যার মধ্যে রয়েছে সেন্ট্রিফিউজ এবং অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র।
ইরানের বিরুদ্ধে দখলদার ইসরাইলকে সামরিকভাবে সহায়তা না করতে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্কতা দিয়েছে রাশিয়া। দেশটির উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই রায়েবকোভ গতকাল বুধবার বলেন, ইসরাইলকে যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সহায়তা করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে।
মোসাদের ড্রোন কারখানা ধ্বংস : ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী তেহরানের উপকণ্ঠে একটি তিনতলা বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ইসরাইলের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ পরিচালিত একটি গোপন ড্রোন ও বিস্ফোরক তৈরির কারখানার খোঁজ পেয়েছে। ইরানের সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল প্রেস টিভি জানিয়েছে, গত রোববার ইরানি পুলিশ একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যাতে দেখা যায়, সেখানে ড্রোনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, যেমন পাখা ও কাঠামোর অংশ আর ধাতব সরঞ্জাম রয়েছে। এসব যন্ত্রাংশ ড্রোন তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।
ইরানের সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, ওই বাড়ির ভেতরেই ড্রোন তৈরি হচ্ছিল। সেখানে যন্ত্রাংশ তৈরির সরঞ্জামও জব্দ করা হয়েছে। খবরে বলা হয়, ড্রোন কারখানার সন্ধান পাওয়ার সাথে ইসরাইলের আগের একটি স্বীকারোক্তি মিলে যায়। পশ্চিমা গণমাধ্যম অ্যাক্সিওসের এক খবরে ইসরাইলি কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, মোসাদ কর্মকর্তারা আট মাস ধরে ইরানে ড্রোন পাচার করছিল, যাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাগুলোয় হামলা চালানো যায়।
ইরানের সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা : আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) বরাতে আলজাজিরা জানিয়েছে, ইরানের দুটি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্র হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। গতকাল বুধবার এক এক্স (সাবেক টুইটার) পোস্টে আইএইএ জানায়, ইরানি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্র টিইএসএ কারাজ ও তেহরান রিসার্চ সেন্টারে হামলা হয়েছে। দুটি কেন্দ্রই একসময় আইএইএর নজরদারির আওতায় ছিল। এর আগে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী দাবি করে, তারা ৫০টির বেশি যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানে হামলা চালিয়েছে। হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল ইরানের সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রসহ একাধিক অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্র। টেলিগ্রামে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা নির্দেশনার ভিত্তিতে এই হামলা চালানো হয়। ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কথা বরাবর অস্বীকার করে এসেছে। দুটি সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রে ইসরাইলি হামলার বিষয়ে ইরানের দিক থেকে এখনো কিছু জানানো হয়নি।
৪ শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান : ইসরাইল-ইরানের মধ্যে গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া সঙ্ঘাত ষষ্ঠ দিনে গড়িয়েছে। পাল্টাপাল্টি হামলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরাইলের দিকে ৪০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে তেহরান। এ ছাড়া ইসরাইলে হামলার জন্য তেহরান কয়েক শ’ ড্রোন পাঠিয়েছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দফতরের বরাতে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন গতকাল বুধবার এসব তথ্য জানিয়েছে। নেতানিয়াহুর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ইরানি হামলায় ইসরাইলে এখন পর্যন্ত ২৪ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৮০০ জনের বেশি। ইরানের হামলার জেরে ৩ হাজার ৮০০ জনের বেশি মানুষকে তাদের বাড়ি থেকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর দফতর।
আরেকটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত : ইরানের রাজধানী তেহরানের কাছে দখলদার ইসরাইলের একটি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। এর আগে দখলদারদের আরো চারটি বিমান ভূপাতিত করার কথা জানিয়েছিল ইরান। নতুন করে আরেকটি যুদ্ধবিমানের পাশাপাশি গতকাল বুধবার ইসরাইলিদের আরো ১৪টি ড্রোনও ধ্বংসের তথ্য জানিয়েছে ইরান। যুদ্ধবিমানটি ভারামিনে বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তসংস্থা ইরনা, যা তেহরানের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। ভারামিনের বিভাগীয় গভর্নর হোসেন আব্বাসি ইরনাকে বলেছেন, ‘একটি ইসরাইলি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভারামিনের কাছে ভূপাতিত করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী বিষয়টি তদন্ত করছে।’ তবে বিমানটির অবস্থা বা পাইলট জীবিত আছে নাকি মারা গেছে তা স্পষ্ট করেননি হোসেন আব্বাসি। ইরানের পুলিশের মুখপাত্র সাঈদ মোন্তাজের আলমেহদি বলেছেন, ইসরাইলি গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ১৪টি ড্রোন ধ্বংস করে দিতে সমর্থ হন তারা। পুলিশের এ কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা ইরনাকে বলেছেন, তেহরান, আলবোর্জ ও ইস্ফাহানের বিভিন্ন জায়গায় সুইসাইড ড্রোন উৎপাদনের কারখানা এবং বিস্ফোরক ডিভাইস শনাক্ত করে সেগুলো ধ্বংস করা হয়।’ এ ছাড়া ড্রোন বহনকারী তিনটি গাড়িও জব্দ করেছে ইরানি বাহিনী। অপর দিকে ইরাকেও ড্রোন বহনকারী গাড়ি জব্দ করা হয়েছে।
মিসাইল প্রতিরোধ ক্ষমতা কমছে ইসরাইলের : দখলদার ইসরাইলের ইরানের মিসাইল আটকানোর ক্ষমতা কমে আসছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল। মার্কিন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইসরাইলিদের অন্যতম শক্তিশালী অ্যারো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফুরিয়ে আসছে। অ্যারোর সক্ষমতা কমে আসায় ইরানের দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল আটকাতে বেগ পেতে হবে দখলদারদের। তবে ইসরাইল ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেনি।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরাইল দাবি করেছে, ইরান এখন পর্যন্ত যেসব মিসাইল ছুড়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই ইসরাইল সফলভাবে ভূপাতিত করেছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করেছে, এখন পর্যন্ত ইরানের ৪০ শতাংশ মিসাইল লঞ্চার ধ্বংস করে দিয়েছে তারা। দখলদার ইসরাইলে বেশ কয়েকটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের থাড ও প্যাট্রিয়ট ব্যবস্থা ব্যবহার করে তারা। এ ছাড়া তাদের নিজস্ব আয়রন ডোম ও ডেভিড সিøং নামে দুটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে।
ইরানের ১০টি ড্রোন ভূপাতিত : আলজাজিরার খবর অনুসারে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলেছে, ইরান থেকে উৎক্ষেপণ করা মোট ১০টি ড্রোন গতকাল সকালে তারা ভূপাতিত করেছে। প্রথমে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা তিনটি ইরানি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। পরে ইসরাইলি বাহিনীর পক্ষ থেকে আরো সাতটি ড্রোন ভূপাতিত করার কথা জানানো হয়। এসব ড্রোনের কারণে ইসরাইল অধিকৃত গোলান মালভূমি এলাকায় সাইরেন বেজে ওঠে।
ইসরাইলি ড্রোন ভূপাতিত : এই প্রথমবারের মতো সফলভাবে একটি ইসরাইলি ড্রোন ভূপাতিত করেছে ইরানের সেনাবাহিনী। গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ১৬ মিনিটে ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় শহর ইস্ফাহানে ভূপাতিত করেছে ইরানের সেনাবাহিনী। ভূপাতিত ড্রোনটি হার্মিস ৯০০ সিরিজের। এই সিরিজের ড্রোনগুলো ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও বিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি। ইসরাইলের নিজস্ব যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনকারী সংস্থা এলবিট সিস্টেমস হার্মিস ৯০০ সিরিজের ড্রোনগুলো তৈরি করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ইতোমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত ড্রোনটির ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ছবি দেখে বোঝা যাচ্ছে যে ড্রোনটি পতিত হয়েছে ইস্ফাহানের জনবিরল অঞ্চলে।
তেলআবিব-জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ : ইসরাইলের জেরুসালেমে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস গতকাল থেকে আগামীকাল শুক্রবার পর্যন্ত তিন দিন বন্ধ থাকবে। একই সময় দেশটির রাজধানী তেলআবিবে দূতাবাসের কনস্যুলার কার্যক্রমও স্থগিত থাকবে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস এক বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছে, বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে চলমান সঙ্ঘাতের ফলে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সরকারি সব মার্কিন কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা তাদের বাসস্থানের ভেতরে এবং কাছাকাছি স্থানে আশ্রয় নেবেন। তবে ইসরাইল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার জন্য মার্কিন নাগরিকদের সহায়তা দেয়ার বিষয়ে এখনই কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ। দূতাবাস আরো জানায়, ইসরাইলের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলো বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এ দিকে ইসরাইলের তেলআবিবের আশপাশের এলাকাগুলো খালি করার নির্দেশ দিয়েছে ইরানের রেভুলিউশনারি গার্ড।
তেহরানে বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা : ইরানের রাজধানী তেহরানের পূর্ব উপকণ্ঠে অবস্থিত ইমাম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ইরানি সংবাদমাধ্যমের বরাতে এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তেহরানের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির সাথে ইরানের অভিজাত বাহিনী ইসলামিক রেভুলেশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে ধরা হয়।
ইসরাইলি বিমানঘাঁটিতে হামলা : ইরান থেকে গতকাল ভোরের দিকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের মধ্যাঞ্চলের একটি এলাকায় আঘাত হানে বলে জানিয়েছে আলজাজিরা। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর এলাকাটিতে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। ইরানের ফারস নিউজ এজেন্সির খবরে বলা হয়, হামলার লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে একটি ছিল ইসরাইলের মেরন বিমানঘাঁটি। এটি ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। তবে ইসরাইলের এই বিমানঘাঁটিতে আসলেই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।



