ব্যাংক খাতে ফরেনসিক অডিটের তাগিদ

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যত দ্রুত ঋণ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে, তত দ্রুত ব্যাংক খাতের পুঁজি ও নিয়ন্ত্রণ শক্ত হবে। তা না হলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও সুদের হার, বৈদেশিক মুদ্রার বাজার, বিনিময় হার সব কিছুর ওপর এই খারাপ ঋণ ও ব্যাংকের অস্থিতিশীল অবস্থার প্রভাব পড়বে।

বিশেষ সংবাদদাতা
Printed Edition

অলিগার্কনির্ভর দুর্বল নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক প্রভাব ও খেলাপি ঋণের পাহাড় বড় সঙ্কট আনতে পারে বলে সতর্কবাণী

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে দীর্ঘদিন আড়াল করে রাখা ফাঁক-ফোকর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ব্যাংকগুলো থেকে কর্তৃত্ববাদী সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত অলিগার্করা নামে বেনামে যে বিপুল ঋণ বের করে নিয়ে গিয়েছিল তা ফেরত না দেয়ার ফলে সৃষ্ট আড়ালে থাকা অনেক খারাপ ঋণ ও অগ্রহণযোগ্য ঝুঁকি এখন সামনে চলে আসছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যত দ্রুত ঋণ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে, তত দ্রুত ব্যাংক খাতের পুঁজি ও নিয়ন্ত্রণ শক্ত হবে। তা না হলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ও সুদের হার, বৈদেশিক মুদ্রার বাজার, বিনিময় হার সব কিছুর ওপর এই খারাপ ঋণ ও ব্যাংকের অস্থিতিশীল অবস্থার প্রভাব পড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে অর্থ পাচার ও ব্যাংকিং খাতে অলিগার্ক প্রভাব থেকে রায় তিন ধাপের কর্মপরিকল্পনা প্রস্তাব করেছেন। তাদের প্রস্তাবিত ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে,অবিলম্বে ফরেনসিক অডিট ও লাভজনক মালিকানা রেজিস্টার চালু, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট পার্টির ঋণ নিয়ন্ত্রণ এবং অ্যাসেট রিকভারি টাস্কফোর্স গঠন করে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা। প্রস্তাবনায় বলা হয়, জনগণের আমানত সুরা এবং অর্থনীতি পুনর্বাসনের জন্য এ পদপেগুলো অবিলম্বে নেয়া জরুরি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছাড়া ব্যাংকিং সিস্টেমকে সুস্থ করা সম্ভব নয়।

এ দিকে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সাম্প্রতিক মূল্যায়নগুলোতে চিহ্নিত সমস্যার বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। তারা মূলত চারটি বড় সমস্যা চিহ্নিত করেছে। তিন সংস্থারই বক্তব্য হলো- বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এখনো অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে, কিন্তু অলিগার্কনির্ভর দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক প্রভাব আর খেলাপি ঋণের পাহাড় আগামী দিনে বড় সঙ্কট ডেকে আনতে পারে।

আইএমএফ বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল এবং অলিগার্ক ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর কারণে ব্যাংক খাত ঝুঁকিতে পড়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে অসুস্থ ঋণের হার (অকার্যকর) অস্বাভাবিকভাবে বেশি, যা আসল চিত্রের চেয়েও কম দেখানো হয়। আইএমএফ জোর দিয়েছে শক্তিশালী ব্যাংকিং আইন, নিয়ন্ত্রক স্বাধীনতা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে। তারা ডলার সঙ্কট মোকাবেলা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংক খাত সংস্কারের শর্ত দিয়েছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপির সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। তারা উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণের হার প্রকাশিত সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি। সংস্থাটি মনে করে, ব্যাংক খাতে শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালনা পর্ষদের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব কমানো না গেলে আর্থিক খাত টেকসই হবে না। বিশ^ব্যাংক ডিজিটাল ব্যাংকিং, ফিনটেক ও ট্রান্সপারেন্সি আনার প্রস্তাব দিয়েছে।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে ব্যাংকিং খাত সংস্কার ছাড়া বিকল্প নেই। তারা সতর্ক করেছে, যদি খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে অর্থনীতিতে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হবে। এডিবি প্রস্তাব দিয়েছে- খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর আইন প্রণয়ন, দুর্বল ব্যাংকগুলোর মার্জার/পুনর্গঠন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক মতা বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (ব্যাসেল-৩) পুরোপুরি বাস্তবায়ন।

অন্য দিকে টিআইবি মনে করে, অলিগার্ক বা বড় মালিকদের ওপর ব্যাংকিং ব্যবস্থার অসাধু প্রভাব বন্ধ করা; ব্যাংকের ঋণদানে স্বচ্ছতা ও নিরপেতা ফিরিয়ে আনা; অতিরিক্ত ঝুঁকি ও সম্পর্কিত পরে ঋণ েেত্র কড়াকাড়ি করা এবং চুরি/সাইফোন করা সম্পদ উদ্ধারে দ্রুত, বৈদেশিক সহযোগিতার দ্বারা কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই ব্যাংক খাতকে রার বিষয়ে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যগুলোতে দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতিপূর্ণ ব্যাংকের অকার্যকর ঋণ ব্যাপক পরিমাণে বেড়েছে। ২০২৫ সালের প্রথমবার্ষিক ত্রৈমাসিকে এ ধরনের খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় ৪.২০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এটা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৪-২৫ শতাংশ এর কাছাকাছি। এই ঋণগুলোর মধ্যে বড় অংশই হলো কুঋণ হিসাবে শ্রেণী বিন্যাসিত, যা আদায়ের সম্ভাবনা নেই।

এর মধ্যে ঋণ শ্রেণিবিন্যাসের নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে। আগে রেকর্ড অনুযায়ী, যে ঋণগুলো দুই থেকে ছয় মাস সময় অতিবাহিত হলে শ্রেণীবিন্যাসিত ধরা হতো, তা সময় কমিয়ে তিন মাসে আনা হয়েছে, যাতে আগের মতো ‘লুকানো দ্রবণ’ কম করা যায়। ’২৪ এর জুলাইয়ের আগে যেসব ঋণ বছরের পর বছর কিস্তি না দেয়ার পরও নিয়মিত দেখানো হতো পরিবর্তনের পর অনেক ব্যাংকের ‘গোপন’ খারাপ ঋণ উন্মোচিত হতে শুরু করেছে। এর মধ্যে অনেক ব্যাংকের পুঁজির ঘাটতি ও ব্যালেন্স শিট দুর্বলতা প্রকাশ হতে শুরু করেছে। অনেক ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততার (সিআরএআর) ঝুঁকি বেড়ে গেছে, কিছু ব্যাংকের েেত্র সিআরএআর কমে গেছে খুব নিচে, যা নিয়ম অনুযায়ী কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয়। ঋণ পুনর্গঠন করা, অবলোপন ও সঞ্চিতি বাড়াতে হচ্ছে, যার ফলে নতুন ঋণ দেয়া কমে যাচ্ছে।

ফ্যাসিবাদী আমলের শাসনগত দুর্বলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংকগুলোর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় ব্যাংকের বোর্ড দখল, ঋণদান ও ঋণগ্রহীতাদের পে ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি ব্যাংক ও কিছু বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ গ্রহীতা অনেক বেশি প্রভাব খাটিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ বের করে নিয়েছে। ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে অনেকেই কিস্তি দিতে পারছেন না বা সময় মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না; এতে ব্যাংকের আয় ও নেট ক্যাশ ফো খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্য ও ক্ষুদ্র শিল্প (এসএমই) ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ক্রেডিট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

সিপিডির পর্যবেণ অনুসারে, পরিচালনা ও নিরীার েেত্র দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ কম, ঝুঁকির মূল্যায়ন, মনিটরিং সিস্টেম খুব দুর্বল অবস্থা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। অনেক ব্যাংকই ‘লিকুইডিটি সঙ্কট’ অনুভব করছে; আমানতের প্রবাহ ও ঋণ-পরিশোধের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া কঠিন হচ্ছে। ফলে আস্থা ও সুনামের সঙ্কটও এখন প্রবল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণ ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাংকিং সেক্টরে আস্থা কমেছে, কারণ মন্দ ঋণ, ঋণগ্রহীতার খেলাপি এবং ‘গোপন ঋণ’ প্রকাশের ঘটনা বাড়ছে। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা ও নীতি বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন যে, যদি মৌলিক সংস্কার না হয় তাহলে রোগ আরো বাড়বে।

এর মধ্যে শুরু হওয়া সংস্কারের অংশ হিসাবে ঋণ শ্রেণিবিন্যাসের নিয়ম কঠোর করা হয়েছে (৬ মাস থেকে ৩ মাসের নিয়মে) যা স্বচ্ছতা বাড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বড়-অডিট প্রতিষ্ঠান (বিগ-৪) দিয়ে কিছু ব্যাংকের সম্পদ-গুণগত স্থিতি পরীা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা অনেক গোপন সমস্যাগুলো প্রকাশ করবে। সরকারের নীতি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপ বেড়ে গেছে; ব্যাংকের সুস্থতা পুনরুদ্ধার ও নৈতিকতার বেড়ে ওঠার দিকে মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। কিছু ব্যাংকে ঋণগ্রহীতাদের বিনিয়োগে ও ঋণ বিতরণে দ্রুততার পরিবর্তন ও কঠোর যাচাইকরণ শুরু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমে অলিগার্ক প্রভাব ও অর্থ পাচার রোধে জরুরি কর্মপরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে অলিগার্কদের রাজনৈতিক প্রভাব, সম্পর্কিত পকে ঋণদান এবং বিদেশে অর্থ পাচার-ব্যাংকিং স্থায়িত্ব ও জনগণের আমানতের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ েেত্র জরুরি করণীয় (০-৬ মাস) হিসাবে স্বাধীন ফরেনসিক অডিট (একিউআর) করে দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রকৃত ঋণমান যাচাই করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। সেসাথে লাভবান মালিকানা রেজিস্টার চালু করে বেনামের ঋণের প্রকৃত মালিক ও শেয়ারহোল্ডার চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন নজরদারি করে অকার্যকর ঋণের সম্পদ দ্রুত ফ্রিজিং প্রক্রিয়া নেয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সাথে বলা হয়েছে- উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ অস্থায়ী তদারকি টিম বসাতে হবে।

মাঝারি মেয়াদি করণীয় (৬-২৪ মাস) হিসাবে সুপারিশ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট পার্টি লেন্ডিংয়ে কড়াকড়ি করে ঋণসীমা ও স্বচ্ছ রিপোর্টিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। ঋণ-তি প্রভিশনিং বাধ্যতামূলক করা। রাজনৈতিক চাপ থেকে মুক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা শক্তিশালী করা। অভ্যন্তরীণ তথ্যদাতাদের নিরাপত্তা ও প্রণোদনা দিয়ে হুইসেলব্লোয়ার প্রটেকশনের ব্যবস্থা করা।

দীর্ঘমেয়াদি করণীয় (২-৫ বছর) হিসাবে ব্যাংক রেজুলিউশন ও ডিপোজিট প্রটেকশন স্কিম; আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় অ্যাসেট রিকভারি টাস্কফোর্স; ডিজিটাল পেমেন্ট মনিটরিং ও এএমএল অ্যালগরিদম চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর প্রত্যাশিত ফলাফল হিসাবে জনগণের আমানত সুরা, ব্যাংকিং খাতে আস্থা পুনর্গঠন ও বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।