চামড়া রফতানিতে সম্ভাবনার চেয়ে সঙ্কটই বেশি

বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো অবকাঠামো এবং মান নিশ্চিত করতে না পারায় দেশ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

শাহ আলম নূর
Printed Edition
রফতানির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে চামড়া
রফতানির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে চামড়া |সংগৃহীত

বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় চামড়া উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ। প্রতি বছর দেশে প্রায় ৩০ কোটি স্কয়ার ফুট চামড়া উৎপাদন হলেও রফতানির বাজারে প্রত্যাশিত সাফল্য ধরা দিচ্ছে না। বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার মতো অবকাঠামো এবং মান নিশ্চিত করতে না পারায় দেশ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশে উৎপাদিত চামড়ার বড় একটি অংশই রফতানিযোগ্য হলেও মান এবং কমপ্লায়েন্স ঘাটতির কারণে তা কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রফতানি হওয়া চামড়ার অর্ধেকের বেশি অংশ যাচ্ছে চীনে। দেশটিতে প্রতি স্কয়ার ফুট চামড়া বিক্রি হচ্ছে ৯০ সেন্ট থেকে ১.২০ ডলারে। অথচ একই চামড়া ইউরোপীয় বাজারে বিক্রি হতে পারত ২ দশমিক ৫০ থেকে ৩ ডলারে।

বাংলাদেশ সরকারের রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-মে) এ খাত থেকে রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। রফতানির এ প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে জুতা খাত, বিশেষ করে চামড়ার জুতা এবং অন্যান্য উপকরণে তৈরি জুতা। চামড়ার জুতা রফতানি এ সময় বেড়েছে ২৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ এবং আয় হয়েছে ৬২০ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার। মে মাসে এ খাতে ৫৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিসহ আয় হয়েছে ৭৪ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার, বিগত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হ্রাস পাওয়ার কারণে বাংলাদেশের চামড়া ও জুতা খাতে ২৫ শতাংশ রফতানি হ্রাস দেখা দিয়েছিল। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে এই শিল্প। মার্কেট ডাইভার্সিফিকেশন, প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং রফতানিতে সরকারি সহায়তা বৃদ্ধির কারণে এ প্রবৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি মো: সাখাওয়াত উল্লাহ নয়া দিগন্তকে বলেন, চামড়ার দাম কমে যাওয়ার প্রধান কারণ আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা হারানো। আমাদের অনেক ট্যানারির এখনো বৈশ্বিক স্বীকৃতি নেই। রফতানির বাজারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বিশেষ করে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না থাকা। এলডব্লিউজি সনদ ছাড়া বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো চামড়া কিনে না। অথচ দেশের মাত্র ৫টি ট্যানারির এই সনদ রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চামড়া মূলত চীনের কিছু এজেন্ট নির্ভর বাজারেই সীমাবদ্ধ। এসব এজেন্ট একচেটিয়াভাবে অল্প দামে চামড়া কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতে তারা তাদের প্রকৃত উৎপাদন খরচও উঠাতে পারছেন না।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি আরো হতাশাজনক হচ্ছে, বাংলাদেশের ফুটওয়্যার ও লেদার গুডস প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো মানের চামড়ার জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক হাজার ৪৯৬ কোটি টাকার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এ বিষয়ে লেদার গুডস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য রফিকুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে প্রচুর চামড়া উৎপাদিত হয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক মান না থাকায় আমরা বাধ্য হয়ে বিদেশ থেকে কিনছি। এতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হচ্ছে এবং দেশীয় শিল্পের প্রতিযোগিতা কমছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) পূর্ণ সক্ষমতায় চালু করা, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন নিশ্চিত করা এবং ট্যানারিগুলোকে এলডব্লিউজি সনদ পেতে সহায়তা করাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ। একই সাথে প্রয়োজন নীতিগত সহায়তা ও ট্যাক্স সুবিধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো: মিজানুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, চামড়া রফতানির বাজারে আমরা এখনো ক্ষুদ্র খেলোয়াড়। অথচ উৎপাদনের দিক থেকে আমরা বড়। এই পার্থক্য দূর করতে হলে আমাদের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অর্জনে সময়ক্ষেপণ করা যাবে না।

তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে ১৪২টি চালু ট্যানারির মধ্যে মাত্র ৫টি ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত। ফলে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের জন্য অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে। অথচ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো কিংবা আমেরিকার বড় ব্র্যান্ডগুলো শুধু এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকেই চামড়া গ্রহণ করে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশকে বাধ্য হয়ে চীনের মতো তুলনামূলক কম দামে কেনা বাজারে চামড়া রফতানি করতে হচ্ছে।

চীন বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান চামড়া আমদানিকারক দেশ। একসময় যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, স্পেন ও জাপান বাংলাদেশ থেকে চামড়া আমদানি করত। কিন্তু এলডব্লিউজি সনদের অভাবে এসব বাজার হারিয়ে যাচ্ছে। ট্যানারি মালিকরা জানান, চীনে প্রতি স্কয়ার ফুট চামড়ার মূল্য ৯০ সেন্ট থেকে ১.২০ ডলার, যেখানে ইউরোপে একই পরিমাণ চামড়া বিক্রি করা যায় ২.৮০ ডলারে। এতে করে প্রতিটি স্কয়ার ফুটে দেড় থেকে দুই ডলার লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

তথ্যে দেখা যায়, সাভারের বিসিক চামড়াশিল্প নগরে বর্তমানে ২০৫টি প্লট রয়েছে এবং অনুমোদিত ট্যানারির সংখ্যা ১৬২টি। চালু রয়েছে ১৪২টি। কিন্তু একটি ট্যানারিও পূর্ণ এলডব্লিউজি কমপ্লায়েন্স পূরণ করতে পারছে না। কারণ, সিইটিপি এখনো আংশিকভাবে কার্যকর। ঈদের মৌসুমে যখন দৈনিক ৪০-৪৫ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তখন সিইটিপির পরিশোধন ক্ষমতা ২৫-৩০ হাজার ঘনমিটারে সীমাবদ্ধ থাকে।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য বলছে, দেশের অভ্যন্তরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৩৬ হাজার কোটি টাকার। চামড়া প্রক্রিয়াকরণের সাথে যুক্ত ২৫০টির বেশি ট্যানারি। চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী বড় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯০টির মতো। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় বিপুল অঙ্কের রফতানি আয় হারাচ্ছে দেশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য মিলিয়ে বছরে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার রফতানি আয় হারাচ্ছে বাংলাদেশ।

বিশ্বের চামড়াজাত পণ্যের বড় বড় ব্র্যান্ড ইউরোপ-আমেরিকার। সেসব ব্র্যান্ডের ক্রেতারা চামড়া কেনার সময় এর মান, ট্যানারিগুলোর পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক রয়েছে কি না তা সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। এলডব্লিউজি সনদও থাকতে হয়। সেই পূর্ণাঙ্গ সনদ আছে দেশের মাত্র পাঁচটি ট্যানারির। বাকি দেড় শতাধিক ট্যানারি উন্নত দেশে চামড়া রফতানি করতে পারছে না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কম দামে চামড়া কিনে নিয়ে যাচ্ছে চীনের কোম্পানিগুলো। চীন এই সনদের এত গুরুত্ব দেয় না।

২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস, টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী মিলে এলডব্লিউজি গঠন করে। পরিবেশ সুরক্ষা করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করার বিষয়টি নিশ্চিত করাই সংস্থাটির লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্বে এক হাজারের বেশি ব্র্যান্ড ও সরবরাহ খাতের প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সদস্য। ওইসব বড় বড় প্রতিষ্ঠান তাদের কাছে চামড়া নিচ্ছে।

সাভারে স্থানান্তরিত ট্যানারি মালিকরা জানান, সিইটিপির তরল বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ হাজার ঘনমিটার। কোরবানির পর ট্যানারিগুলো পুরোদমে চামড়া প্রক্রিয়াজাত শুরু করলে তখন ৪০ থেকে ৪৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য উৎপাদন হয়, যা সিইটিপির সক্ষমতার অনেক বেশি। এটা এ খাতের কমপ্লায়েন্সের বড় বাধা। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সনদের শর্ত পূরণ করার সক্ষমতা হলেও সিইটিপি সংক্রান্ত কারণে তারা পিছিয়ে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।