লোহিত সাগরের তীরের প্রাচীন শহর জেদ্দার আল-বালাদ। গত বৃহস্পতিবারের গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা নামতেই এই ঐতিহাসিক জনপদ রূপ নিয়েছিল বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জে। লোহিত সাগরের নোনা হাওয়ায় তখন মিশে যাচ্ছিল হলিউড, বলিউড আর আরব সিনেমার গ্ল্যামার। ঝলমলে আলোর রোশনাই আর সুদীর্ঘ রেড কার্পেটে পা রাখছিলেন একের পর এক কিংবদন্তি। সৌদি আরবের এই প্রাচীন স্থাপত্যের কোল ঘেঁষেই অনুষ্ঠিত হলো রেড সি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পঞ্চম আসরের জমকালো সমাপ্তি অনুষ্ঠান ও ‘ইউসর অ্যাওয়ার্ডস’। যদিও উৎসবের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয় ১৩ ডিসেম্বর, তবে পুরস্কার বিতরণের রাতটিই ছিল আসরের মূল আকর্ষণ। পুরস্কার বিতরণের এই সন্ধ্যায় রেড কার্পেটে উপস্থিত ছিলেন হলিউড সুপারস্টার জনি ডেপ, কিংবদন্তি অভিনেতা অ্যান্থনি হপকিন্স, ব্রিটিশ অভিনেতা ও পরিচালক ইদ্রিস অ্যালবা। তাদের উপস্থিতিতে উৎসবের জৌলুশ বহুগুণ বেড়ে যায়। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ খ্যাত মার্কিন পরিচালক ড্যারেন অ্যারোনোফস্কি, ব্রিটিশ-মালয়েশিয়ান তারকা হেনরি গোল্ডিং এবং হলিউডের জনপ্রিয় অভিনেতা এডগার রামিরেজ। বলিউড থেকে এসেছিলেন মেগাস্টার সালমান খান। আন্তর্জাতিক তারকাদের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য ও সৌদি আরবের নিজস্ব শিল্পীদের পদচারণায় মুখর ছিল অনুষ্ঠানস্থল। সৌদি অভিনেত্রী মারিয়া বাহরাউই, সারা তাইবাহ, সামার শেশা এবং নির্মাতা শাহাদ আমীন ও আলী কালথামিরা নিজ দেশের সিনেমার এই অভাবনীয় সাফল্যে আবেগাপ্লুত ছিলেন।
বিশ্বখ্যাত নির্মাতা ড্যারেন অ্যারোনোফস্কি আরব নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘এই উৎসব আমার চোখ খুলে দিয়েছে। এখানকার তরুণ নির্মাতাদের গল্প বলার ঢং ও সৃজনশীলতা অনুপ্রেরণাদায়ক। রেড সি উৎসব এশিয়া ও আফ্রিকার প্রতিভাদের জন্য এক অসাধারণ যোগসূত্র তৈরি করেছে।’ সৌদি তরুণ নির্মাতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এত বিশাল যে অনেক গল্প এখনো অজানাই রয়ে গেছে। ভয় না পেয়ে নিজের জীবনের গল্পই পর্দায় তুলে ধরুন।’ উৎসবের জুরি বোর্ডের সদস্য তথা ব্রিটিশ অভিনেত্রী নাওমি হ্যারিস বলেন, ‘আমি সত্যিই অভিভূত। এখানে এতো মেধা লুকিয়ে আছে যা আমি আগে কখনো ভাবিনি। এই উৎসবের মাধ্যমে সেই কণ্ঠস্বরগুলো তাদের প্রাপ্য প্ল্যাটফর্মটি খুঁজে পেল।’
এবারের আসরের মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘সিনেমার ভালোবাসায়’। উৎসবে সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শতাধিক চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে সেরা চলচ্চিত্র ও কলাকুশলীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে ১৫টি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। উৎসবের ‘আরব স্পেকটাকুলার’ বিভাগে বিশেষভাবে নজর কেড়েছে ফিলিস্তিনি নির্মাতা অ্যানেমারি জাসিরের ‘প্যালেস্টাইন-৩৬’ এবং সৌদি নির্মাতা হাইফা আল-মনসুরের ‘আনআইডেন্টিফাইড’। অন্যদিকে ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেকটাকুলার’ বিভাগে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি অভিনীত ‘কাউচার’ এবং সৌদি আরবের মরুভূমিতে চিত্রায়িত ‘ডেজার্ট ওয়ারিয়র’ দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী ছাড়াও উৎসবের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল ‘ইন কনভারসেশন’ সেশন। যেখানে ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চন, ডাকোটা ফ্যানিং ও অ্যাড্রিয়েন ব্রডির মতো তারকারা তাদের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের চড়াই-উৎরাই নিয়ে কথা বলেছেন। পাশাপাশি উৎসবে অংশ নেয়া বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশের ১৬০ জন প্রদর্শক তাদের চলচ্চিত্রের বাজার সম্প্রসারণে ‘রেড সি সউক’-এ মিলিত হন। জেদ্দার ঐতিহাসিক আল-বালাদ থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব সৌদি আরবের ভিশন ২০৩০-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিশ্ব দরবারে আরবের নতুন পরিচয় তুলে ধরল। গতকাল শনিবার উৎসবের শেষ প্রদর্শনী হয়। তবে বৃহস্পতিবারের এই মায়াবী রাতটি বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে দীর্ঘকাল অমলিন হয়ে থাকবে।



