গাজা চুক্তিকে আঞ্চলিক শক্তির খেলায় রূপ দিলেন এরদোগান

Printed Edition

নয়া দিগন্ত ডেস্ক

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় গাজা যুদ্ধবিরতির চুক্তি বাস্তবায়নে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগানের ভূমিকা তুরস্ককে নতুন কূটনৈতিক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। এক সময় হামাসের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ওয়াশিংটনের কাছে রাজনৈতিক ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হলেও, এখন তা একটি ভূরাজনৈতিক সম্পদে পরিণত হয়েছে। রয়টার্স।

হামাস প্রথমে ট্রাম্পের চুক্তি প্রত্যাখ্যান করলেও পরে তুরস্কের অনুরোধে তা গ্রহণ করে। আঙ্কারার বার্তা ছিল স্পষ্ট- ‘সময়ের দাবি, চুক্তি মেনে নিতে হবে।’ এই চাপের ফলে হামাস যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তির পরিকল্পনায় সম্মত হয়। ট্রাম্প নিজেও এরদোগানের প্রশংসা করে বলেন, ‘তুরস্কের এই ভদ্রলোক বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতাদের একজন। তিনি সবসময় পাশে থাকেন।’

এই চুক্তিতে এরদোগানের স্বাক্ষর তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্য নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করেছে। বিশ্লেষক সিনান উলজেন বলেন, এই সাফল্য তুরস্ককে ওয়াশিংটনে নতুন কূটনৈতিক সুবিধা এনে দিয়েছে। এরদোগান এখন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির স্থগিত আলোচনা আবার শুরু, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শিথিল এবং সিরিয়ায় নিরাপত্তা লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা চাইতে পারেন।

এই কূটনৈতিক পুনর্গঠন শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে এরদোগানের হোয়াইট হাউজ সফরের সময়। সেখানে রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার কারণে আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং সিরিয়ায় কুর্দি বাহিনীর বিষয়ে আলোচনা হয়। তুরস্ক চায়, মার্কিন-সমর্থিত এসডিএফ বাহিনী সিরীয় সেনাবাহিনীতে একীভূত হোক, যা আঙ্কারার জন্য কৌশলগত জয়।

গাজা চুক্তির আগে রাশিয়া-ইউক্রেন আলোচনায় তুরস্কের ভূমিকা এবং সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর আঙ্কারার প্রভাব বৃদ্ধিও এরদোগানের কূটনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, এরদোগানের এই পদক্ষেপ ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক নেতৃত্ব পুনরুদ্ধারের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন।

তবে তুরস্কের এই উত্থান ইসরাইল ও আরব প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য উদ্বেগের কারণ। মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো এরদোগানের অবস্থান নিয়ে সতর্ক। লেবাননের বিশ্লেষক সারকিস নাওম বলেন, ‘তুরস্কের বড় ভূমিকা আরব দেশগুলোকে ওসমানীয় শাসনের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়।’

হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতি কোনো আত্মসমর্পণ নয়, বরং মানবিক সঙ্কট ও জনমতের চাপে একটি বাস্তবিক সিদ্ধান্ত। চুক্তির মাধ্যমে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় আটক ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তি এবং গাজায় ৬৭ হাজারের বেশি নিহতের পর যুদ্ধবিরতির পথ খুলে যায়।

তবে এই চুক্তি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের পথ খুলবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত। তুরস্ক, কাতার ও মিসর বলছে, চুক্তিতে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। এরদোগান জানিয়েছেন, গাজায় তুর্কিয়ে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে, তবে অগ্রাধিকার হলো পূর্ণ যুদ্ধবিরতি, ত্রাণ সরবরাহ এবং পুনর্গঠন।

তুর্কিয়ে সাইপ্রিয়টদের তুরস্কে যোগদানের আহ্বান এরদোগান মিত্রের : এ দিকে রয়টার্স জানায়, তুরস্কের জাতীয়তাবাদী নেতা ও প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগানের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেবলেত বাহচেলি উত্তর সাইপ্রাসকে তুরস্কে যুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। এই মন্তব্য এসেছে এমন এক সময়, যখন উত্তর সাইপ্রাসে সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মধ্য-ডানপন্থী নেতা তুফান এরহুরমান বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন এবং গ্রিক সাইপ্রাসের সাথে শান্তি আলোচনা আবার শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

বাহচেলি বলেন, ‘সাইপ্রাস তুর্কিয়ে এবং এটি তুর্কিদের মাতৃভূমি।’ তিনি দ্বীপের ফেডারেল সমাধানের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে উত্তর সাইপ্রাসের সংসদকে তুরস্কে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে ভোট আয়োজনের আহ্বান জানান। এরদোগান নিজে নতুন নির্বাচিত নেতা এরহুরমানকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘এই নির্বাচন উত্তর সাইপ্রাসের গণতান্ত্রিক পরিপক্বতা প্রমাণ করেছে।’ তবে তিনি যোগ করেন, তুরস্ক সবসময় উত্তর সাইপ্রাসের সার্বভৌম অধিকার রক্ষায় পাশে থাকবে।

এই রাজনৈতিক উত্তাপ এমন সময় দেখা দিলো, যখন দীর্ঘ আট বছর পর সাইপ্রাসে শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এরহুরমান দ্বীপে দ্বি-জাতিগত, দ্বি- ভৌগোলিক ফেডারেশন গঠনের পক্ষে, যা গ্রিক সাইপ্রাস সরকারের সাথে সমঝোতার ভিত্তি হতে পারে। তবে বাহচেলির মন্তব্য তুরস্কের জাতীয়তাবাদী শিবিরের অবস্থানকে তুলে ধরেছে, যারা দ্বীপের বিভাজন স্থায়ী করতে চায় এবং তুরস্কের সাথে সরাসরি সংযুক্তির পক্ষে।

ফিলিস্তিনে দুই-রাষ্ট্র সমাধানে গ্যারান্টার হতে প্রস্তুত তুরস্ক : ফিদান

অপরদিকে টিআরটি ওয়ার্ল্ড জানায়, ফিলিস্তিনে দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়িত হলে আঙ্কারা গ্যারান্টার (নিরাপত্তা ও বাস্তবায়ন নিশ্চয়তাকারী) হিসেবে দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান। মিসরের শারম আল-শেখে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে “ঐতিহাসিক” আখ্যা দিয়ে তিনি এই মন্তব্য করেন।

ফিদান তুরস্কের একটি টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘যদি দুই-রাষ্ট্র কাঠামো বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে আমরা আবারো যুদ্ধ দেখতে পারি। এমনকি এটি যুদ্ধ নয়, বরং আরেকটি গণহত্যা হয়ে উঠতে পারে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, আঙ্কারার অগ্রাধিকার হলো- চুক্তির শর্ত মানা, মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা, গাজার প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের হাতে তুলে দেয়া এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া।

তুরস্কের এই অবস্থান এমন এক সময়ে এসেছে, যখন গাজা যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা চলছে। আঙ্কারা মনে করে, এই সুযোগে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের ভিত্তি তৈরি করা জরুরি। বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যারান্টার হিসেবে তুরস্কের ভূমিকা শুধু কূটনৈতিক নয়, বরং এটি আঞ্চলিক ভারসাম্য ও নিরাপত্তা কাঠামোতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

তুরস্ক ইতোমধ্যে গাজা যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং হামাসকে চুক্তি মানতে রাজি করাতে সক্রিয় ছিল। তবে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দীর্ঘদিনের আস্থাহীনতা, সীমান্ত নির্ধারণ, জেরুসালেমের মর্যাদা এবং শরণার্থী ইস্যু- সবই এই সমাধানের পথে বড় বাধা। তুরস্কের এই প্রস্তাবের মাধ্যমে আঙ্কারা মধ্যপ্রাচ্যে তার ঐতিহাসিক প্রভাব ও নেতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।

ওসমানীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসেবে তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছে। তবে গ্যারান্টার হিসেবে তুরস্কের ভূমিকা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা নির্ভর করবে অন্যান্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির প্রতিক্রিয়ার ওপর। কাতার, মিসর এবং যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে গাজা চুক্তিতে সক্রিয় থাকলেও, ইসরাইল তুরস্কের ভূমিকা নিয়ে বরাবরই সন্দিহান। তবে হাকান ফিদান স্পষ্ট করেছেন, ‘আমরা শুধু সমালোচনা করতে চাই না, আমরা সমাধানের অংশ হতে চাই।’